নিউ টাউনে সিন্ডিকেটের জমি দখলের ব্যবসার কথা তো প্রকাশ্যেই শোনা যায়। কিন্তু তার পিছনেই রয়ে যায় আর এক জমি দখলের গল্প। এ জমি রাজনীতির জমি!
নিউ টাউন-রাজারহাটের নির্মাণকাজ শুরু হতেই দানা বেঁধেছিল সিন্ডিকেট। অভিযোগ, তৎকালীন বাম নেতাদের একাংশের ছত্রচ্ছায়াতেই বেড়ে উঠেছে একের পর এক দল। অনুগত সৈনিক তৈরি করেছেন ‘দাদা’। তাদের আমলে সিন্ডিকেট তৈরির কথা স্বীকার করে সিপিএম-এর প্রবীণ নেতা ও প্রাক্তন বিধায়ক রবীন মণ্ডল বলেন, “নিউ টাউন তৈরির সময়ে যাঁরা জমি হারিয়েছিলেন, তাঁদের নিয়ে কো-অপারেটিভ তৈরি হয়। এমন ৪৮টি কো-অপারেটিভ মিলে বেশ কিছু সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছিল। এই সিন্ডিকেটগুলোয় নজরদারি চালাতে কমিটিও হয়। সব রাজনৈতিক দলের ছেলেরাই এই সব সিন্ডিকেট সুষ্ঠু ভাবে চালাতে পারতেন। আজকের মতো সিন্ডিকেট নিয়ে গুন্ডামি বা গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব শুরু হয়নি।” অভিযোগ নস্যাৎ করে বর্তমান তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত বলছেন, “সে সময়ে সিন্ডিকেটের সন্ত্রাসের বাতাবতরণ তৈরি করেছিল সিপিএম। রুইসের মতো গুন্ডাদের দিয়ে জমি দখল, ভেড়ি দখল থেকে নানা ধরনের দুষ্কর্ম চালিয়েছে তারা।” রবীনবাবু বলেন, “ভাল-মন্দ নানা ধরনের মানুষ আমাদের দলে মিশেছে। কিন্তু দল কাউকে অসামাজিক কাজ করতে নির্দেশ দেয়নি।”
এলাকাবাসীদের একাংশের মত, এক সময়ে সিপিএমের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা রুইস বা ভজাই ক্ষমতা বদলের পর তৃণমূলে ভিড়েছে। নিউ টাউনের তৃণমূলের অন্দরের খবর, ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের আগে থেকেই তৃণমূলের একাংশের সঙ্গে যোগাযোগ হয় ভজাইয়ের। সে বারই প্রথম সিপিএমকে হারিয়ে ছ’টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে পাঁচটি তৃণমূল জেতে। দলের একাংশের মতে, ভজাইকে কাজে লাগিয়ে ভাল ফল করেছিল তৃণমূল। অভিযোগ, ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে দলের এক দাপুটে নেতার হাত ধরে তৃণমূলে ঢোকে ভজাই। তখন সব্যসাচীবাবু বলেছিলেন, “লোহা কাটতে লোহা দরকার। এলাকায় সিপিএম এর সন্ত্রাস রুখতে শক্ত লোক চাই।” এলাকার লোকেরাই বলেন, ভজাই ও তার সঙ্গীদের হাত ধরেই বামেদের ছায়ায় থাকা রুইসের মতো দাগি দুষ্কৃতীদের হটিয়ে নিউ টাউনের দখল নিয়েছিল শাসক দল।
দলের একাংশ অবশ্য ভজাইকে দলে নেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি করেছিলেন। ধোপে টেকেনি। বরং ভজাই ও তার বাহিনীর দাপটে পিছিয়ে পড়ে পুরনো তৃণমূলের অধীন সিন্ডিকেটগুলি। সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই বলছেন, নিউ টাউনে জমি দখলে ভজাইয়ের পাল্টা গোষ্ঠী দলে টেনেছে একদা সিপিএম ঘনিষ্ঠ রুইসকে। তাতে বিরোধী গোষ্ঠীর জমিও কিছুটা পোক্ত হয়েছে। পাল্টা রাজনৈতিক জমি দখলে নেমেছেন রুইসের মদতদাতারাও। গোলমালও নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে। যদিও তৃণমূলের সর্বভারতীয় সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “রাজারহাট-নিউ টাউনে তিন মাস আগে ভোট হয়েছে। ১৬ হাজারের বেশি ভোটে তৃণমূল জিতেছে। সিন্ডিকেট বা কোনও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে এই এলাকার মানুষ যদি অস্বস্তিতে থাকতেন বা অখুশি থাকতেন, তা হলে তৃণমূল এখান থেকে এত বিপুল ভোটে জিতত না।”
বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, নিজেদের দলের অফিসও রেহাই পাচ্ছে না। পালাবদলের পরে নিউ টাউনে দলীয় অফিস খুলেছিল তৃণমূল। সম্প্রতি দলের একাংশই সেই অফিস ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ। এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের আঁচ পেয়েছে তৃণমূল ভবনও। তাই বিধায়ক, সাংসদ-সহ স্থানীয় নেতাদের নিয়ে বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু সুরাহা করতে পারেননি তাঁরা।
দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মিটুক বা না-মিটুক, তা পরের কথা। কিন্তু সেই দ্বন্দ্ব এমন ভাবে সাধারণ জীবনে ছাপ ফেলবে, এটা ভেবে নেওয়া সত্যিই কঠিন। এই অবস্থায় নিউ টাউনের বাসিন্দাদের প্রশ্ন, আদৌ কি সিন্ডিকেটের এই লড়াই থেকে মুক্তি পাবেন তাঁরা?
প্রশ্নটা সঙ্গত। উত্তরটা অবশ্য এখনও অজানা।
(শেষ)