স্নেহা বণিকের বাড়িতে তার বন্ধুরা ও পোষ্য বুকু। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র
রাস্তার আনাচ-কানাচে এখনও গোড়ালি ডোবা জল। কোথাও আবার জল ছুঁয়ে রয়েছে হাঁটুও। জলমগ্ন সেই ঝিলপাড়ের রোয়াকে বসে পড়শি মহিলা বিড়বিড় করছিলেন, ‘‘পাখি ফিরবে না আর। তবু এই জলের দিকে তাকালে এখনও সেই ফুটফুটে মেয়েটার মুখটাই ভেসে উঠছে।’’
বান্ধবনগরের ক্লাস সিক্সের পড়ুয়া, স্নেহা বণিকের ডাক নাম পাখি। পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে এ নামেই এত দিন পরিচিত ছিল বছর বারোর বালিকা। বুধবার বিকেলে ওই রাস্তায় হাঁটু জল ভেঙে এগোতে গিয়ে পিছলে পড়ার সময়ে রাস্তার পাশের বাতিস্তম্ভে হাত লেগে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে শুধু স্নেহা নয়, মারা গিয়েছে এলাকার আরও এক বালিকা অনুষ্কা নন্দী। তার মা প্রিয়াঙ্কা নন্দী ঘরের মেঝেয় বসে একটানা বলে চলেছেন, ‘‘৩০ তারিখ (সেপ্টেম্বর) মেয়েটার জন্মদিন ছিল গো! পুজোর আগে কেউ এ ভাবে চলে যায়!’’ দমদমের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের প্রান্তিক এই পাড়া সেই শোকেই স্তব্ধ এ দিনও। চুপ করে আছে পাখির পোষ্য বুকু। বাড়িতে পড়শিরা ভিড় করলে তাদের মধ্যেই আকুল হয়ে সে খুঁজে ফিরছে বন্ধুকে।
স্নেহা ও অনুষ্কার বাড়িতে শোকের পাশাপাশি রয়েছে চাপা ক্ষোভও। এ দিন সকাল থেকে দু’বাড়িতেই রাজনৈতিক নেতারা পৌঁছলে বার বার তা সামনে এসে পড়েছে। সকালে দমদমের ওই এলাকায় দু’টি পরিবারের সঙ্গেই দেখা করেন স্থানীয় তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় এবং বিধায়ক তথা শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তাঁদের সঙ্গেই সেখানে দেখা গিয়েছে, স্থানীয় পুরসভার মুখ্য প্রশাসক-সহ প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্যদের। বেলা গড়ালে দু’বাড়িতেই পৌঁছন প্রদেশ মহিলা কংগ্রেসের সদস্যেরা। তাঁরা স্থানীয় প্রশাসনের গাফিলতির অভিযোগ করতেই তপ্ত হয়ে ওঠে পরিবেশ। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সঙ্গে শুরু হয়ে যায় বচসা। শোকের পরিবেশ ভুলে প্রায় হাতাহাতিতে গড়ায়।
বান্ধবনগরের এই বাতিস্তম্ভে হাত লেগেই ঘটে দুর্ঘটনা। তার পরে সেখানকার খোলা তার টেপ দিয়ে আটকে দিয়েছেন সিইএসসির কর্মীরা। নিজস্ব চিত্র
যা নিয়ে ব্রাত্য বলেন, ‘‘সরকার সব রকম ভাবেই ওই দুই পরিবারের পাশে রয়েছে। তবে একান্ত আবেদন এ নিয়ে কেউ রাজনীতি করবেন না।’’ সৌগত রায় জানান, ওই মর্মান্তিক ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে পুর কর্তৃপক্ষকে। কী করে এমন ঘটনা ঘটল, তার তদন্তও শুরু হয়েছে।
স্থানীয় পুরসভার মুখ্য প্রশাসক জানান, ইতিমধ্যেই এক সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী তিন দিনের মধ্যেই কমিটির রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা। কারও গাফিলতি থাকলে যথাযথ ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। তবে, রাজ্য সরকার এবং পুরসভার তরফে দুই পরিবারকে যথাক্রমে দুই এবং এক লক্ষ টাকা করে তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে ইতিমধ্যেই।
বৃহস্পতিবার এলাকা ঘুরে দেখা গিয়েছে, বাতিস্তম্ভগুলির অধিকাংশই ঘিরে রাখা হয়েছে। এলাকার বাসিন্দাদের সতর্কও করা হচ্ছে। তবে তারই মধ্যে, জলমগ্ন দু’-একটি বাতিস্তম্ভ যে চোখে পড়েনি এমন নয়। কেন? স্থানীয় ওয়ার্ড কোঅর্ডিনেটর তথা প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য সুরজিৎ রায়চৌধুরী অবশ্য এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। তিনি বলেন, ‘‘যা বলার পুর কর্তৃপক্ষ বলবেন।’’ মুখ্য প্রশাসক জানাচ্ছেন, দক্ষিণ দমদমের ৩৫টি ওয়ার্ডে প্রায় ৭ হাজার
বাতিস্তম্ভ রয়েছে। সিইএসসি বিদ্যুৎ পরিষেবা দিলেও বাতিস্তম্ভ রক্ষণাবেক্ষণের কাজ পুরসভার। অথচ সে সব নজরদারির পরিকাঠামো নেই পুর কর্তৃপক্ষের!