তৃণমূলের বুথ এজেন্টের কাছেও জোড়হস্ত পুলিশ

হাতজোড় করে ফেললেন পুলিশ অফিসার! মন্ত্রী নন, নেতা নন, তৃণমূলের সামান্য এক বুথ এজেন্টের সামনে। শুধু হাতজোড় নয়, একেবারে করজোড়ে কাতর অনুনয়! শনিবার তখন বেলা দেড়টা। ২১ নম্বর ওয়ার্ডে বিনানি ধর্মশালা ভোটকেন্দ্রের সামনে তখন ভিড় জমজমাট। বিজেপি প্রার্থী জানকী সিংহের অভিযোগ, বুথ জ্যাম করে ছাপ্পা ভোট দিচ্ছে তৃণমূল। কিন্তু শাসক দলের পাল্টা দাবি, ভোট হচ্ছে শান্তিপূর্ণ। এই নিয়ে ক্রমশ ভিড় জমছিল বুথের সামনে। সেখানকার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন কলকাতা পুলিশের এক সাব-ইনস্পেক্টর।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২০
Share:

ঘুমে অচেতন শান্তিরক্ষকেরা। শনিবার পার্ক সার্কাস এলাকায় প্রদীপ আদকের তোলা ছবি।

হাতজোড় করে ফেললেন পুলিশ অফিসার!
মন্ত্রী নন, নেতা নন, তৃণমূলের সামান্য এক বুথ এজেন্টের সামনে। শুধু হাতজোড় নয়, একেবারে করজোড়ে কাতর অনুনয়!
শনিবার তখন বেলা দেড়টা। ২১ নম্বর ওয়ার্ডে বিনানি ধর্মশালা ভোটকেন্দ্রের সামনে তখন ভিড় জমজমাট। বিজেপি প্রার্থী জানকী সিংহের অভিযোগ, বুথ জ্যাম করে ছাপ্পা ভোট দিচ্ছে তৃণমূল। কিন্তু শাসক দলের পাল্টা দাবি, ভোট হচ্ছে শান্তিপূর্ণ। এই নিয়ে ক্রমশ ভিড় জমছিল বুথের সামনে। সেখানকার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন কলকাতা পুলিশের এক সাব-ইনস্পেক্টর। কিন্তু তিনি ওই অবস্থায় কঠোর পদক্ষেপ করা দূরে থাক, করজোড়ে কাতর অনুরোধ শুরু করলেন তৃণমূলের এজেন্টকে, ‘‘এই নিয়ে অযথা তর্ক করবেন না। প্লিজ! ’’
রাজ্য সরকার আগাগোড়া বিরোধিতা করে এলেও কলকাতায় অবাধ ভোট করাতে নির্বাচন কমিশনার কিন্তু কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছিলেন। পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম দাবি করেছিলেন, কলকাতা-সহ রাজ্যের সর্বত্র পুর নির্বাচনের জন্য পুলিশই যথেষ্ট। অনেক টালবাহানার পরে কেন্দ্রীয় বাহিনী এলেও সংখ্যায় তা যৎসামান্য। যে সব এলাকায় গন্ডগোলের সম্ভাবনা নেই, সেখানেই তাদের মোতায়েন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আর যে পুলিশের ওপর রাজ্য সরকারের অগাধ ভরসা দেখিয়ে এসেছে, তাদের ভূমিকা কী ছিল, একের পর এক ঘটনাতেই তা পরিষ্কার। বিরোধীরা বলছেন, শাসক দলের স্বার্থেই কাজ করে গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থাকা এই বাহিনী। ক্ষুব্ধ ভোটারদের অনেকে তো আবার দুষ্কৃতীদের সঙ্গে সমন্বয়ের গন্ধও পেয়েছেন পুলিশের কাজে।
জোড়াবাগানের একটি বুথ, মাঙ্গলিক কমিউনিটি হলের সামনে পুলিশ থাকলেও একের পর লোক শুধু ভোটার স্লিপ নিয়েই ঢুকে পড়ছেন। তাঁদের সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র রয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখার নাম নেই পুলিশের। কেন পরীক্ষা হচ্ছে না? ওই অফিসারের কড়া উত্তর, ‘‘পরীক্ষা তো হচ্ছে। আপনি দাঁড়িয়ে দেখুন!’’ এর পর কয়েক জনের পরীক্ষা হল। কিন্তু সাংবাদিক একটু আড়ালে যেতেই আবার যে কে সেই।
সাংবাদিকের উপস্থিতি পুলিশকে অস্বস্তিতে ফেলেছে ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে রাজা রামমোহন রায় সরণির উপরে থাকা ভোটকেন্দ্র ‘ক্যালকাটা অ্যাকাডেমি’-তেও। বেলা সাড়ে ১১টা। ভোটারের লা‌ইন চোখে না পড়ায় খটকা লাগতেই উঁকি দেওয়া ওই ভোটকেন্দ্রের একটি বুথে। কার্যত রে-রে করে ছুটে এলেন এক এএসআই। বললেন, ‘‘ভিতরে ঢুকতে গেলেন কেন? রাস্তাতেই তো বললাম, এখানে ৩২ শতাংশ ভোট পড়েছে।’’ এর পর সাংবাদিকের পিঠে হাত রেখে ওই এএসআই বাইরের রাস্তা দেখিয়ে বললেন, ‘‘অন্য জায়গায় যান প্লিজ।’’ এই সব কথার মধ্যেই এক দল যুবক হইহই করে ভোটকেন্দ্রে ঢুকে পড়ল। এএসআই কিন্তু বাধা দিলেন না।
আর এ দিন বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের রাজাবাজার তল্লাটের টাকি গার্লস স্কুলের বাইরে বোমাবাজি শুরু হলেও বেশ কিছু ক্ষণ পুলিশকে দেখাই গেল না! পর পর বেশ কয়েকটি বোমা পড়ার খবর পেয়ে পুলিশের একটি দল সেখানে পৌঁছল কেন্দ্রীয় বাহিনীর কয়েক জন জওয়ানকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু তাঁদের সামনেই রাস্তার উল্টো দিকে দু’টো বোমা পর পর ফাটল। তখনও পুলিশ কার্যত স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে।
৬৭ নম্বর ওয়ার্ডের বোসপুকুর শ্রী প্রভাত বিদ্যালয় হিন্দু স্কুলে এ দিন দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, অদূরেই বাজারের পাশে ঘাঁটি গেড়ে এক দল যুবক। তাঁদের কয়েক জন বার বার ওই বুথের ভিতরে ঢুকছেন আর বেরোচ্ছেন। বুথের বাইরে তখন কসবা থানার এক পুলিশকর্মী। ওই যুবকেরা ভোটার না-হওয়া সত্ত্বেও কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে না? ওই পুলিশকর্মীর কাছ থেকে জবাব মেলেনি।
বিরোধীদের অভিযোগ কানে না-তোলার নালিশও উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। ১১০ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম প্রার্থী উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়কে সকালে গাড়ি থেকে নামিয়ে তৃণমূলের এক দল সমর্থক চড় মারে বলে অভিযোগ উঠেছে। উজ্জ্বলবাবু বলেন, তিনি সরাসরি পাটুলি থানার ওসিকে ফোন করেন। ওসি ফোন ধরেননি। অতিরিক্ত ওসিকে ফোনে পান। তিনি বলেন নির্বাচন পর্যবেক্ষককে জানাতে। উজ্জ্বলবাবুর কথায়, ‘‘আমার অভিযোগ শুনতেই চায়নি পুলিশ!’’
পল্লীশ্রী এলাকায় ৯৮ নম্বর ওয়ার্ডের শিশুভারতী প্রাথমিক স্কুল। দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায় প্রধান গেটের একপাশে জটলা করছে জনা পনেরো লোক। সামনেই পুলিশ। কিন্তু ১০০ মিটারের নিয়ম মেনে ওই জটলাকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। তাঁরা যথেচ্ছ ঘোরাফেরা করছেন। ৯৯ নম্বর ওয়ার্ডে নেতাজিনগর এলাকার বিদ্যাসাগর কেয়াবাগান তল্লাটের বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুলিশ চক্কর মেরে যাওয়ার পর এক দল দুষ্কৃতী এসে তাণ্ডব করল, গুলি চালাল। এক মহিলার কথায়, ‘‘দুষ্কৃতীরা যেতেই আবার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এল পুলিশ। যেন মনে হল, সবটাই সাজানো!’’
৩২ নম্বর ওয়ার্ডের প্রফুল্ল প্রতাপ বিদ্যায়তনে ভোটারদের লাইন যেন এগোচ্ছিলই না। অভিযোগ উঠছিল, ইভিএমের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে ভোট দেওয়া দেখছেন কয়েক জন তৃণমূল কর্মী। এই নিয়ে লাইনে দাঁড়ানো ভোটারদের কেউ কেউ খানিকটা উত্তেজিত হতেই ময়দানে নেমে পড়ল পুলিশ। কয়েক জন ভোটারের হাত থেকে ভোটার স্লিপ কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেললেন তাঁরা। ছিঁড়ছেন কেন? সাংবাদিকদের দেখে খানিকটা থমকালেন তাঁরা। তার পর বললেন, ‘‘গোলমাল এড়ানোর জন্যই করছি।’’ গোলমাল এড়াতে কাগজ ছিঁড়ে কী লাভ? সেই প্রশ্নের কোনও জবাব অবশ্য মেলেনি।
এ দিন বেলেঘাটার ৩৩, ৩৪ ও ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় সব ভোটকেন্দ্রের সামনেই দাপিয়ে বেড়াতে দেখা যায় তৃণমূল কর্মীদের। মোড়ে মোড়ে তৃণমূলের কর্মীরা শ’য়ে শ’য়ে জড়ো হয়েছেন এবং এতে সাধারণ ভোটাররা ভয় পেয়েছেন বলে বিরোধীদের অভিযোগ। কিন্তু পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।
পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার প্রায় একই চিত্র ২ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটকেন্দ্র রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্রেফ স্লিপ দেখেই পুলিশ বুথে ঢুকতে দিচ্ছে, পরিচয়পত্র দেখার বালাই নেই।
তৃণমূল নেত্রী অবশ্য বলছেন, ‘‘এ দিনের ভোটে ম্যান অব দ্য ম্যাচ পুলিশই।’’ আর কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থের দাবি, ‘‘পুলিশ এ দিন পেশাদার ও নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করেছে। কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া ভোট শান্তিপূর্ণ। পুলিশ সব ক্ষেত্রেই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ায় কোনও ঘটনাই বড় আকার নিতে পারেনি।’’ তাঁর বক্তব্য, শহরের দু’টি জায়গা—নিউ মার্কেট ও বাঘা যতীনে গুলি চলেছে বলে অভিযোগ উঠলেও তার প্রমাণ মেলেনি।
সিপি-র যুক্তি, বড় কোনও ঘটনা যে ঘটেনি, তার প্রমাণ শনিবারের ভোটে কেউ গুরুতর আহত হননি। তবে সিপি যখন লালবাজারে সাংবাদিক বৈঠক করছেন, তখনও গিরীশ পার্কে শাসক দলের কর্মীদের গুলিতে এক সাব-ইনস্পেক্টরের জখম হওয়ার খবর এসে পৌঁছয়নি। পরে অবশ্য লালবাজারের অন্য এক শীর্ষকর্তা বলেন, ‘‘ওটা ভোট চলাকালীন কোনও ঘটনা নয়। নির্বাচন-উত্তর একটি ঘটনা।’’ সারা দিন ভোটে গোলমাল পাকানোর অভিযোগে শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে শনিবার রাত পর্যন্ত পুলিশ ৫৮ জনকে গ্রেফতার এবং একটি বন্দুক ও পাঁচটি বোমা উদ্ধার করেছে।
এ দিন পুলিশের ‘পক্ষপাতমূলক’ ভূমিকার প্রতিবাদে সোমবার বিকেলে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ থেকে লালবাজার অভিযান করবে বামফ্রন্ট। সিপিএম নেতা রবীন দেব বলেন, ‘‘পুলিশি পরিকাঠামোর সাহায্যে সন্ত্রাস চালায় তৃণমূল। বহিরাগতরা হামলা করলেও পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল।’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, ‘‘হামলায় পুলিশ সহযোগিতা করেছে। পুলিশই সাংবাদিকদের উপরে হামলা চালিয়েছে।’’
কলকাতা পুলিশের এক সহকারী কমিশনার এক চিত্র সাংবাদিকের ক্যামেরায় ধাক্কা এবং তাঁকে শারীরিক হেনস্থা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। তবে সিপি জানান, এই অভিযোগ বিকেল পর্যন্ত পাননি।
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর অভিযোগ, ‘‘এই ভোটে পুলিশ বাহিনীকে তৎপরতার সঙ্গে ব্যবহার করেছে তৃণমূল।’’ তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, ‘‘ভোটদান অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হওয়ার জন্য পুলিশ-প্রশাসনকেও আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement