— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
শীতের রাতে রাস্তার ধারে আগুন জ্বালাতে দেখলেই ব্যবস্থা নেবে পুলিশ। কলকাতার ট্র্যাফিক গার্ডগুলিতে লালবাজার থেকে এমনই নির্দেশ গিয়েছে বলে সূত্রের খবর। সেই সঙ্গেই কোন কোন এলাকায় রান্না বা অন্য কোনও কাজে উনুন জ্বালানো হয়, তা-ও দেখতে বলা হয়েছে থানাগুলিকে। এই সংক্রান্ত রিপোর্ট দ্রুত লালবাজারে জমা দেওয়ার কথা। সেখান থেকে পুলিশ রিপোর্ট পাঠাবে জাতীয় পরিবেশ আদালতে। সম্প্রতি, পরিবেশ আদালতের এক নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে নড়েচড়ে বসেছে রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। তার জেরেই পুলিশের এই উনুন অভিযান শুরু হতে চলেছে বলে খবর।
এই পরিপ্রেক্ষিতে শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে ঘুরে দেখা গেল, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ রক্ষার দিক থেকে সচেতনতার প্রচার চালানো সত্ত্বেও উনুনের ব্যবহার এখনও বন্ধ করা যায়নি। বরং দেদার জ্বলছে কয়লা বা জ্বালানি কাঠের উনুন। পুলিশ সূত্রেই উঠে আসছে, কলকাতা শহরের সংযুক্ত এলাকায় উনুন ব্যবহারের চিত্র। সেখানে এখনও বহু পাড়ায় কয়লার উনুন জ্বালিয়ে ইস্ত্রি করার কাজ হয়, বস্তি এলাকায় চলে উনুনে রান্নার কাজ। এমন উনুনের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে হরিদেবপুর, পাটুলি, পঞ্চসায়র, বাঁশদ্রোণী, গরফা এলাকায়। এর পাশাপাশি কলকাতা পুলিশে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ভাঙড় এলাকা। মূলত গ্রামাঞ্চল হওয়ায় সেখানে উনুন এবং শীতের রাতে আগুন জ্বালানোর প্রবণতা বেশি। এই এলাকার নবনির্মিত চারটি থানা থেকেই উনুন সংক্রান্ত রিপোর্টের বেশির ভাগ যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে পরিবেশকর্মীরা জানাচ্ছেন, শুধু রিপোর্ট তৈরি করলেই হবে না, এ নিয়ে আরও সচতনতা প্রচার প্রয়োজন। শীতকালে সূর্যের তাপ কম থাকায় বায়ুদূষক পদার্থগুলি এমনিতেই খুব কম উচ্চতায় থাকে। তা ছাড়া এই সময়ে হাওয়ার গতিবেগ কম থাকায় দূষিত পদার্থ অনেকটা অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে না, বরং একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তাই তখন উনুনের জ্বালানি বা তাপ পোহানোর জন্য কিছু পোড়ানো হলে তা অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। বক্ষরোগ চিকিৎসক ধীমান গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, ‘‘কাঠকুটো, জঞ্জাল পোড়ালে রান্নার গ্যাসের চেয়ে অনেক বেশি ধোঁয়া হয়। আমাদের দেশের মহিলাদের, যাঁদের রান্নার জায়গাতেই অনেকটা সময় কাটে, তাঁদের মধ্যে থেকে শ্বাসযন্ত্রের সমস্যার অভিযোগ বেশি আসার কারণ রান্নার এই জ্বালানি। পুরুষদের ক্ষেত্রে যেমন সিগারেট, মহিলাদের ক্ষেত্রে তেমন জ্বালানি। অপরিসর রান্নার জায়গা এই সমস্যা আরও বাড়িয়ে তোলে।’’ তাঁর দাবি, ‘‘মাঝে এই ব্যাপারটা কিছুটা কমেছিল। এখন রান্নার গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় আবার পুরনো, অস্বাস্থ্যকর ব্যবস্থা ফিরছে।’’ চিকিৎসকদের দাবি, সমীক্ষা বলছে, সারা দেশে কাঠকয়লার উনুনের দূষণ বছরে অন্তত আট লক্ষ অকালমৃত্যুর কারণ।
দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উজ্জ্বলা যোজনা (গরিব পরিবারের মহিলাদের জন্য নিখরচায় রান্নার গ্যাসের সংযোগ) চালু করার সাত বছর পরেও গোটা দেশে গ্রামাঞ্চলে অর্ধেকেরও কম পরিবারে রান্নার গ্যাসে রান্না হচ্ছে। এ রাজ্যের অবস্থা আরও করুণ। এখানকার গ্রামের ৭৬ শতাংশ পরিবারেই রান্না হচ্ছে কাঠ, ডালপালা জ্বালিয়ে। খাস কলকাতাতেও বহু জায়গায় চলছে উনুনে রান্না।
বাগবাজারের হাজার বস্তির কাছে দেখা গেল, কোলের মেয়েকে বসিয়ে রেখে পাশেই চলছে উনুনে রান্না। কালো ধোঁয়ায় ভরে রয়েছে আশপাশ। এই নিয়ে আলোচনা শুরু হতেই কাছের চায়ের দোকানে হাজির এক মাঝবয়সি ব্যক্তি বললেন, ‘‘মোদী যে বছর ক্ষমতায় এলেন, সে বছর সরকার ২৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছিল কেরোসিনে। কমতে কমতে ২০২১-’২২ সালের বাজেটে তা শূন্য হয়ে গিয়েছে। ২০১৬ সালে উজ্জ্বলা প্রকল্প ঘোষণা হল। গ্যাসের সংযোগ পেলেন অনেকেই। কিন্তু সিলিন্ডারের যা দাম দাঁড়াল, তাতে গ্যাসের সংযোগ এখন অভিশাপ হয়ে উঠেছে। না
পারা যাচ্ছে ব্যবহার করতে, না ফেলে দিতে! তাই এখনও অনেকের কাছেই উনুন ভরসা।’’