বেপরোয়া: হেলমেট ছাড়াই পুজোর শহরে ঘোরাফেরা। পার্ক সার্কাস এলাকায়। ফাইল চিত্র
অষ্টমীর সন্ধে। দক্ষিণ কলকাতার এক থানায় কাঁচুমাচু মুখে বসে আছেন তিন জোড়া তরুণ-তরুণী। হেলমেট না পরে মোটরবাইক চালানোর অভিযোগে ধরা হয়েছে তাঁদের। একটু পরেই ঢুকলেন থানার বড়বাবু।
ধরে আনা ছ’জনকে ভাল মতো জরিপ করে প্রশ্ন করলেন, ‘‘পুজো বলে কি আইন মানার দরকার নেই? হেলমেট কোথায় আপনাদের?’’
কাঁদো কাঁদো গলায় এক তরুণী বললেন, ‘‘স্যার, আজই অনেক টাকা দিয়ে বিউটি পার্লার থেকে মেক-আপ করিয়ে এসেছি। চুল সেট করিয়েছি। হেলমেট পরলে তো সবই মাটি!’’
বিস্ময়ে হতবাক বড়বাবু আর কথা বাড়াননি।
পুজোর কয়েক দিন এ ভাবেই ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ শিকেয় তুলে রাখল শহর। অধিকাংশ বাইক-আরোহীদেরই এক অদ্ভুত ধারণা রয়েছে যে, পুজোর সময়ে হেলমেট পরাটা আবশ্যিক নয়। পুলিশ কিছু করবে না। হেলমেট না পরার দায়ে পুলিশ আটক করলে প্রায় প্রত্যেকেই এমন যুক্তি দিয়েছেন।
সপ্তমীর সন্ধ্যায় ই এম বাইপাসের সায়েন্স সিটি মোড়ে বিনা হেলমেটের এক মোটরবাইক আরোহী দম্পতিকে আটক করেছিলেন কর্তব্যরত ট্র্যাফিক সার্জেন্ট। হেলমেট নেই কেন জিজ্ঞাসা করতেই পিছনের সিটে বসা ওই মহিলা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেন, ‘‘পুজোর সময়ে আবার হেলমেট কীসের?’’ ওই ট্র্যাফিক সার্জেন্ট জানান, পুজোর সময়ে অধিকাংশ মোটরবাইক আরোহীই হেলমেট পরতে চান না।
উল্টোডাঙা থেকে গড়িয়া— ই এম বাইপাসের প্রায় ১৮ কিলোমিটার রাস্তায় পুজোর চার দিন মোটরবাইকের দৌরাত্ম্য সামলাতে হিমশিম খেয়ে গিয়েছেন কর্তব্যরত ট্র্যাফিক পুলিশের কর্মীরা। বেলেঘাটা, কসবা, পূর্ব যাদবপুর ও তিলজলা ট্র্যাফিক গার্ডের অধীনে প্রায় শতাধিক মামলা হয়েছে শুধু মোটরবাইক নিয়ে। বেশির ভাগই মত্ত অবস্থায় ও বিনা হেলমেটে বাইক চালানোর অভিযোগে।
ই এম বাইপাস সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, পুজোর চার দিনই ওই এলাকার সব ক’টি পানশালা খোলা ছিল। রাতে সে সব জায়গায় মদ খাওয়ার পরে উদ্দাম গতিতে মোটরবাইক চালিয়ে বেরিয়ে যেত মত্ত যুবকের দল। অনেকে আবার শব্দবিলাসের জন্য খুলে দিতেন বাইকের ‘সাইলেন্সর’ পাইপ। ফলে, সেই বিকট আওয়াজে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠত আশপাশের লোকজনের।
পুলিশ জানিয়েছে, পুজোর ভিড়ে উদ্দাম গতির বাইক ধাওয়া করে ধরতে কালঘাম ছুটে গিয়েছে তাদের। এক সার্জেন্টের কথায়, ‘‘মোটরসাইকেল থামিয়ে ‘ব্রেথ অ্যানালাইজার’ দিয়ে পরীক্ষা করার পরে কাছাকাছি কোনও থানায় নিয়ে যাওয়া হত ওই যুবকদের। সেখানে অনেকেই চেষ্টা করতেন, প্রভাবশালী কারও নাম করে পার পেয়ে যাওয়ার। কিন্তু কোনও ভাবেই তাঁদের রেহাই দেওয়া হয়নি।’’ এক ট্র্যাফিক-কর্মী বলেন, ‘‘বডি ক্যামেরায় সব কথা রেকর্ড করা হচ্ছে। এটা জানার পরে অনেক কেষ্ট-বিষ্টুই আর বেশি দূর এগোননি। থানা থেকে সোজা সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে রক্ত পরীক্ষা করিয়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে।’’
এক পুলিশকর্তা জানান, পাঁচটি ট্র্যাফিক গার্ডের সার্জেন্ট, কনস্টেবল ও সিভিক ভলান্টিয়ার-সহ প্রায় ২০০ জন কর্মীকে ই এম বাইপাসের নজরদারির কাজে নিয়োগ করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কেউ মারা যাননি।
পুজোর সময়ে মোটরবাইক-দৌরাত্ম্য নিয়ে আগাম আশঙ্কা ছিল পুলিশের। এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘ট্র্যাফিক গার্ড সংলগ্ন থানাগুলির সঙ্গে সমন্বয় রাখা হয়েছিল। কোথাও কোনও ঘটনা ঘটলেই স্থানীয় থানা ও ট্র্যাফিক পুলিশ একযোগে মোকাবিলা করবে, এমনই পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পুজোর সময়ে ওই কৌশলেই কাজ হয়েছে।’’ পুলিশ জানায়, বাইপাসের মূল রাস্তায় একটি মোটরবাইককে ধাওয়া করা হয়েছিল। অলিগলি দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেও পার পায়নি সেটি। এলাকার ভিতর থেকেও বিনা হেলমেটে বা মত্ত অবস্থায় থাকা বেশ কয়েক জন বাইক আরোহীকে ধরা হয়েছে।
মোটরবাইক নিয়ন্ত্রণে পুলিশকর্তারা যতই নিজেদের সফল বলে দাবি করুন, পুজোর সময়ে বাইকের দাপটে তটস্থ হয়ে ছিলেন বাইপাসের অন্য গাড়ির চালক ও সাধারণ পথচারীরা।