দৃপ্ত: মল্লিকবাজার মোড় থেকে পার্ক সার্কাস পর্যন্ত বর্ষপূর্তির মিছিলে। বৃহস্পতিবার। ছবি: সুমন বল্লভ
‘‘যারা রবীন্দ্রনাথের পদবি টেগোর আর ঠাকুর আলাদা বলে মনে করে, এমন একটা দল ভাবছে বাংলার ক্ষমতা দখল করবে। রবীন্দ্রনাথ আর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বাংলায় ওদের কোনও ঠাঁই নেই।’’— মাইকে হিন্দিতে গর্জে উঠছিলেন পার্ক সার্কাসের তরুণ সৈয়দ আসাদ। তাঁর পাশে হুইলচেয়ারে আসীন আসমত জামিল। বৃহস্পতিবার বিকেলে সাত মাথার মোড়ে নামজাদা বিরিয়ানি রেস্তরাঁর সামনে তখন ভিড় জমেছে। ঠিক এক বছর আগে আসমতের ডাকেই শুরু হয়েছিল দিল্লির শাহিন বাগের আদলে পার্ক সার্কাসের ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন’! ২০২১-এর ভোট-আবহ বোঝাচ্ছে নাগরিকত্ব আইনের নামে বিভাজন-বিরোধী সেই প্রতিবাদ এখনও সমান প্রাসঙ্গিক।
তবে নতুন করে পার্ক সার্কাসের মাঠে ধর্না শুরু হোক, তা চায়নি কলকাতা পুলিশ তথা রাজ্য প্রশাসন। এক বছর আগে আসমতের ডাকে শুরু ধর্না ক্রমশ গোটা কলকাতা তথা বাংলার সংবিধান রক্ষা আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছিল। লকডাউনে গোটা দেশ ঘরবন্দি হওয়া ইস্তক ওই মাঠই ছিল নানা শ্রেণির মানুষের রাত-দিনের ঘরবাড়ি। সেই আন্দোলনের বর্ষপূর্তির দিনে অনেক কিছুই পাল্টেছে। ফুসফুসের ক্যানসারে কাহিল আসমতের শরীরটা ভাল নেই। এক দিন আগেই রক্ত নিতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এ দিন সেখান থেকেই মিছিলে যোগ দেন তিনি।
মল্লিকবাজার মোড় থেকে আসমতকে সামনে রেখে পার্ক সার্কাসের মেয়েদের মিছিল শুরুর মুহূর্তেই পথ আটকায় পুলিশ। আসমতকে তারা বলে, আপনি যেখানে খুশি যান, মিছিল যেতে দেওয়া যাবে না। আসমত বলেন, ‘‘আমার সঙ্গে গোটা বাংলা রয়েছে। তারাই আমার পরিবার। একা কিছুতেই যাব না।’’ পুলিশ পার্ক সার্কাসের মাঠ তালাবন্ধ রাখে। শেষমেশ সাত মাথার মোড়ে বিরিয়ানির দোকান পর্যন্ত এগোতে দেয় মিছিল। হুইলচেয়ারে চেপেই মিছিলে শামিল আসমতের হাতে ছিল দিল্লি সীমানায় কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতির মন্ত্র। শহরের প্রবীণ শিখ সতনম সিংহ অহলুওয়ালিয়াও কৃষকদের লড়াইয়ের খবরে উস্কে দিলেন প্রতিবাদী জনতাকে। তাঁর বক্তৃতা শেষ হল, একই সঙ্গে ‘খুদা হাফেজ়’, শিখদের ‘রব রাখে এবং ‘শুভ সন্ধ্যা’ সম্ভাষণে।
এ দেশের আবহমান বহুত্ববাদী সুরটাই মূর্ত মিছিলের নানা রঙা ভিড়ে। মিছিলের পুরোভাগে পার্ক সার্কাস, খিদিরপুর, হাওড়া পিলখানার মুসলিম মেয়েদের পাশেই তৃতীয় লিঙ্গভুক্ত রূপান্তরকামী মেয়ে, পুরুষের ঝাঁক। তাঁদের মধ্যে অনুরাগ মৈত্রের দৃপ্ত আবৃত্তি স্পর্শ করল। উমর খালিদের ছবি বুকে হাঁটছিলেন প্রবীণ দীপ্তি লাহিড়ী, সুনন্দা দাস প্রমুখ। গত লোকসভা ভোটে সিপিএমের এজেন্ট হিসেবে তাঁদের দেখা গিয়েছিল। কারারুদ্ধ ভারভারা রাও, স্ট্যান স্বামীরাও পোস্টারে পোস্টারে এই মিছিলের মুখ। পার্ক সার্কাসের ধর্নার পরিচিত মুখ, অকালপ্রয়াত রায়া দেবনাথের ছবি নিয়েও হাঁটলেন তাঁর বন্ধুরা। রায়ার মা-বাবা আলপনা দত্ত, কুশল দেবনাথেরাও ছিলেন মিছিলে। ব্রাইট স্ট্রিটের শাবিনা রিজ়ভি, পিলখানার অালবি খান, খিদিরপুরের আরমিনা শাহাবরা ক্ষুব্ধ, অল্প ক্ষণ সভা করে সরে যাওয়ার কথা দিলেও কেন পার্ক সার্কাসে ঢুকতে দিল না মিছিল।
প্রতিবাদে নাছোড় জেদকে টলাতে পারেনি কোনও বাধাই। আট বছরের ইউটিউবার আঁখি ওরফে সহজিয়াও মা-বাবার হাত ধরে এসেছে। সবাইকে নিয়েই মিছিল আগামীর দিকে চলল।