নির্যাতিতার সঙ্গে কথা বলেছেন রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র।
প্রায় কোনও কিছুই মিলছে না। পঞ্চসায়রের হোমের ‘ধর্ষিতা’ মহিলা এবং তাঁর বোন পুলিশের কাছে অভিযোগে যা যা জানিয়েছিলেন, তদন্তকারীরা মাঠে নেমে প্রায় তার কোনও কিছুই মেলাতে পারছেন না। ওই দু’জনের বয়ান এবং সিসি ক্যামেরার ফুটেজের মধ্যে প্রায় কোনও মিল নেই বলেই জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা। তাঁদের দাবি, তদন্তের কাজ যত এগোচ্ছে, ততই সংশয় বাড়ছে। ওই মহিলা এবং পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছেন রাজ্য মহিলা কমিশনের সদস্যরাও। তাঁরাও সংশয়ের কথা তেমন ভাবে আড়াল করেননি। ফলে প্রশ্ন উঠছে, আদৌ ধর্ষিতা হয়েছিলেন তো ওই মহিলা?
মহিলা এবং এবং তাঁর বোনের বয়ান কী ছিল? দু’জনেই জানিয়েছিলেন, সোমবার রাতে হোম থেকে বেরনোর পর ওই মহিলাকে একটি গাড়িতে জোর করে তুলে নিয়ে যায় দু’জন যুবক। তাঁদের এক জন অন্য জনকে ফিরোজ নামে ডাকছিল বলেও জানান ওই মহিলা। এর পর ওই গাড়িতেই তাঁকে অনেক ক্ষণ ধরে ঘোরানো হয়। সেই সময়ে দিদিকে গণধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ করেন তাঁর বোন। পরে সোনারপুরের কাছে একটি খালপাড়ে তাঁকে ফেলে দেওয়া হয়। সেখান থেকে কয়েক জন নিত্যযাত্রী তাঁকে টিকিট কেটে বালিগঞ্জ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। বালিগঞ্জ নেমে প্রথমে গড়িয়াহাটের এক আত্মীয় এবং তার পর বেহালায় বোনের বাড়িতে পৌঁছন ওই মহিলা।
তদন্তে নেমে ওই এলাকার বিভিন্ন রাস্তার সিসি ক্যামেরার ফুটেজে কী পেল পুলিশ? তদন্তকারীদের একটি অংশ জানাচ্ছেন, ফুটেজে দেখা গেল একটি নয়, গাড়ি ছিল দু’টি। হোমের সামনে কোনও সিসি ক্যামেরা নেই। ফলে প্রথম গাড়িতে ওঠার কোনও ফুটেজ পাওয়া যায়নি। কিন্তু কিছুটা দূরের অন্য এক সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে, প্রথম গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার উপরেই অন্য একটি সাদা রঙের গাড়িকে হাত দেখিয়ে থামাচ্ছেন মহিলা। তার পর তাতে উঠে পড়়েন তিনি। ফলে জোর করে গাড়িতে তোলার বিষয়টি এখানেই বড়সড় প্রশ্নের মুখে পড়ছে বলে জানাচ্ছেন তদন্তকারীদের ওই অংশ। কারণ, বয়ানে দ্বিতীয় কোনও গাড়ির কথা ছিল না। পরের সংশয় তৈরি হয় সোনারপুর নিয়ে।
ফরেন্সিক এবং বিভিন্ন সূত্র মারফৎ তদন্তকারীরা আরও কয়েকটি জায়গায় সংশয় প্রকাশ করছেন। নিজস্ব চিত্র।
সিসি ক্যামেরার ফুটেজ তদন্তকারীদের কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছে, দ্বিতীয় গাড়ি করে ওই মহিলা নরেন্দ্রপুর গিয়েছিলেন। বয়ানে এই নরেন্দ্রপুরের কথাও ছিল না বলে মনে করিয়ে দিচ্ছেন তদন্তকারীরা। তৃতীয় সংশয় তৈরি হয়েছে মহিলার পোশাক নিয়ে। পুলিশের কাছে তাঁর বোন যে রক্তমাখা হলুদ রঙের নাইটি জমা দিয়েছিলেন, তার কোনও অস্তিত্ব সিসি ক্যামেরার ফুটেজে মেলেনি বলেই তদন্তকারীদের দাবি। কারণ হিসেবে তাঁরা জানাচ্ছেন, সব জায়গার ফুটেজেই দেখা যাচ্ছে, ওই রাতে মহিলার পরনে ছিল লাল রঙের গাউনের মতো একটি পোশাক।
আরও পড়ুন: সিন্ডিকেট নিয়ে রণক্ষেত্র নিউটাউন, সব্যসাচীর হাত ধরে কি দখলদারিতে নামল বিজেপিও!
সিসি ক্যামেরার পাশাপাশি ফরেন্সিক এবং বিভিন্ন সূত্র মারফৎ তদন্তকারীরা আরও কয়েকটি জায়গায় সংশয় প্রকাশ করছেন। যেমন, হোমের তরফে জানানো হয়েছিল ওই রাতে নোড়া দিয়ে দরজার তালা ভেঙে বাইরে বেরিয়ে পড়েছিলেন মহিলা। কিন্তু ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, তালা ভাঙা হয়নি। বরং রীতিমতো চাবি দিয়েই তা খোলা হয়েছিল। একইসঙ্গে তাঁরা দাবি করেছিলেন, রাত দুটো নাগাদ ওই তালা ভেঙে বেরনোর ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সূত্র মারফৎ পুলিশ জানতে পেরেছে, ওই মহিলা রাত সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে বেরিয়েছিলেন এবং তিনি জানতেন তালার চাবি কোথায় থাকত। তা হলে হোম কর্তৃপক্ষ কেন তালা ভাঙার কথা বলেছিলেন, সময় সম্পর্কেও বিভ্রান্ত করেছিলেন— তা ভাবাচ্ছে পুলিশকে। ঠিক যেমন ভাবেই ভাবাচ্ছে, নিত্যযাত্রীদের বিষয়টি। কারণ, ওই দিন ভোররাতে মহিলাকে নিত্যযাত্রীদের কেউ নন বরং একদল কীর্তনিয়া তাঁকে পৌঁছে দিতে সাহায্য করেন। কিন্তু কোথায় পৌঁছে দিয়েছিলেন? পুলিশ চুপ। একইসঙ্গে ট্রেন-বালিগঞ্জ-গড়িয়াহাট-বেহালা— মহিলার এই যাত্রাপথ নিয়ে তদন্তকারীরা কিছু বলতে চাইছেন না। মন্তব্য করতে চাইছেন না কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান মুরলীধর শর্মাও। তিনি শুধু বলছেন, ‘‘এখনও সময় আসেনি এ সব বলার।’’
আরও পড়ুন: উৎসবে আছেন, কিন্তু ডেঙ্গিতে নেই শোভন
পুলিশের পাশাপাশি ওই মহিলার সঙ্গে কথা বলেন রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়-সহ অন্য সদস্যেরা। শুক্রবার তিনি বলেন, “আমরা পুলিশ, ওই মহিলা, তাঁর বোন— সকলের সঙ্গে কথা বলেছি। ধর্ষণ হয়েছে কি হয়নি, তা এখনও বলার সময় আসেনি। মেডিক্যাল রিপোর্ট হাতে এলে এ বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা যাবে। তবে সংশয়ের একটা অংশ তো রয়েইছে।” এ সবের মধ্যেই ওই মহিলার মা বার্ধক্যজনিত কারণে বৃহস্পতিবার রাতে মারা গিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে ওই দিনই কথা বলেছিলেন লীনা। তিনি বলেন, “অবিবাহিত মেয়ে হিসাবে ওই মহিলা যাতে বাবার সম্পত্তি পান, তিনি তাঁর বাড়িতেই যাতে নিরাপদে থাকতে পারেন, সে বিষয়ে নজর রাখবে কমিশন।”
এরই মধ্যে এই ঘটনা সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে রাজ্যে এসেছে জাতীয় মহিলা কমিশনের একটি দল। এ দিন লালবাজারে গিয়ে জাতীয় মহিলা কমিশনের সদস্য চন্দ্রমুখী দেবী গোয়েন্দা প্রধানের সঙ্গে দেখা করেন। বেশ কিছু ক্ষণ এ বিষয়ে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়। এর আগে এ দিন তিনি ‘ধর্ষিতা’র সঙ্গে দেখা করেন। ওই দিন ঠিক কী ঘটেছিল, তা-ও তিনি জানতে চান তাঁর কাছে। চন্দ্রমুখী দেবীর দাবি, তাঁর উপর নির্যাতন হয়েছে বলেই তাঁকে জানিয়েছেন ওই মহিলা জানিয়েছেন। তবে পুলিশের ‘ঢিলেঢালা’ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘‘রাত ১০টাতেই যদি কাউকে এ ভাবে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়, তা হলে গভীর রাতে কী হবে?’’
এ প্রসঙ্গে গোয়েন্দা প্রধান জানিয়েছেন, “তদন্ত কোন পর্যায় রয়েছে, গণধর্ষণ হয়েছে কি হয়নি, এ বিষয়ে কোনও লিখিত রিপোর্ট দেওয়া হয়নি মহিলা কমিশনকে।” তিনি আরও জানান, এখনও পর্যন্ত ১০০-র কাছাকাছি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ খতিয়ে দেখা হয়েছে। ফৌজদারি বিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে ‘ধর্ষিতা’র গোপন জবানবন্দি নেওয়ার জন্য ইতিমধ্যেই আবেদন জানানো হয়েছে। আগামী ১৯ নভেম্বর গোপন জবানবন্দি দেওয়ার জন্যে তাঁকে হাজির করানোর নির্দেশ দিয়েছে আলিপুর আদালত।
অভিযোগ জানানোর পর বেশ কয়েক দিন কেটে গেলেও অভিযুক্তরা অধরা। এমনকি পুলিশ এখনও ঘটনার কিনারাই করে উঠতে পারেনি। উল্টে অভিযোগকারিণীর বয়ান নিয়েই সংশয় প্রকাশ করছে বলে ইতিমধ্যেই অভিযোগ করতে শুরু করেছে রাজ্যের বিরোধী দলগুলি। রাজ্য বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বলছেন, ‘‘অভিযোগকারিণীর দিকে আঙুল তুলে এই সব ঘটনা চাপা দেওয়াই তো তৃণমূল প্রশাসনের কাজ। পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের মতো এ বারও অভিযোগকারিণীর কথাতেই অসঙ্গতি রয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে।’’
আরও পড়ুন: গাড়িতেই প্রসব, এগিয়ে এলেন তরুণ ডাক্তারেরা
রাজ্য বিজেপির মহিলা মোর্চার সভানেত্রী তথা হুগলির সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়ও একই কথা বলছেন। তিনি বলেন, ‘‘বীরভূমে একটি ধর্ষণের ঘটনাতেও এই রকম ভূমিকা নিয়েছিল পুলিশ। সেখানে জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রতিনিধিদের দেখাই করতে দেওয়া হয়নি নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে। কমিশনের প্রতিনিধিকেই ওখানে গিয়ে হুমকির মুখে পড়তে হয়। এ ক্ষেত্রেও তৃণমূলী দুষ্কৃতীদের পুলিশ আড়াল করার চেষ্টা করেছে।’’
সিপিএমের গলাতেও একই সুর। বিধানসভার বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী এ দিন বলেন, ‘‘এলাকাবাসীর মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ রয়েছে। এখানে তো প্রশাসনের শাসন চলে না, চলে মমতার শাসন। নবান্ন থেকে হয়তো এখনও সবুজ সঙ্কেত আসেনি, তাই ঠিক কী ঘটনা ঘটেছিল এখনও পুলিশ জানাতে পারছে না। নির্দেশ এলেই ওরা বলবে।’’
বিরোধীদের এই অভিযোগ নিয়ে তৃণমূল কী বলছে? দলীয় সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার বলেন, ‘‘সায়ন্তন বসুদের কথার জবাব দিতে চাই না। দেশ জুড়ে মহিলাদের সঙ্গে ওঁদের দল কী করছে, সে সবাই জানে। উত্তরপ্রদেশে বিজেপির বিধায়কের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা চলছে। তা নিয়ে গোটা দেশ উত্তাল। কোথাও গণধর্ষণ, কোথাও মেয়েদের পুড়িয়ে মেরে দেওয়া হচ্ছে। এর পরে বিজেপি নেতারা যদি আমাদের দিকে আঙুল তোলেন, তা হলে সে অভিযোগের জবাব দেওয়ার দায় রয়েছে বলে আমি মনে করি না।’’