প্রয়াত বিজ্ঞাপন জগতের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব রাম রে। (ছবি: ফেসবুক)
চলে গেলেন বিজ্ঞাপন জগতের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব রাম রে। বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। মঙ্গলবার সকালে তিনি প্রয়াত হন কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে।
অর্ধ শতকেরও বেশি সময় রাম রে ছিলেন বিজ্ঞাপন জগতের বিশিষ্ট নাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর টুপিতে যুক্ত হয়েছে একের পর এক পালক। অসংখ্য কালজয়ী বিজ্ঞাপনের সঙ্গে জড়িয়ে তাঁর নাম।
দেশের একাধিক নামী বিজ্ঞাপন সংস্থায় কর্মরত ছিলেন তিনি। ভারত ও আমেরিকার জেডব্লুটি-তে তিনি ছিলেন চার দশকেরও বেশি সময়। বিশ্বের বিভিন্ন শহরে জেডব্লুটি-র শাখা বিস্তারে রাম রে-এর ভূমিকা ছিল অগ্রণী। এরপর আরও এক নামী বিজ্ঞাপন সংস্থা, ক্ল্যারিয়ন (বেটস)-এর তিনি ছিলেন কান্ডারি। পরে, ১৯৮৪ সালে তিনি শুরু করেন নিজের সংস্থা ‘রেসপন্স ইন্ডিয়া গ্রুপ’।
আরও পড়ুন: আর কখনও স্কুলবাসে চড়ব না
গণমাধ্যমের বিভিন্ন শাখায় সারা জীবনে তিনি কাজ করেছেন দেড়শোরও বেশি ক্লায়েন্টের সঙ্গে। প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজি ও সংস্কৃত সাহিত্যের এই প্রাক্তন ছাত্রের হাত ধরেই কয়েক আলোকবর্ষ পাড়ি দিয়েছিলে ভারতীয় বিজ্ঞাপন জগত। তাঁর সৃষ্টিশীল মনের পরিধি ছিল ফোটোগ্রাফি, টাইপোগ্রাফি, গ্রাফিক্স, সাহিত্য-সহ নানা বিষয়ে বিস্তৃত। কলকাতা ছিল তাঁর বিশেষ আগ্রহের একান্ত পরিসর। বলা হয়, সত্যজিৎ রায়ের পরে যাঁদের হাত ধরে সাবালকত্বের পথে এগিয়েছে কলকাতার বিজ্ঞাপন দুনিয়া, তাঁদের মধ্যে রাম রে অন্যতম।
তাঁর কাছ থেকেই এসেছে ‘ফ্রুটি’, ‘বোরোলিন’, ‘কুকমি’, ‘ডাবর চ্যবনপ্রাশ’, ‘মার্গো সাবান’, ‘মাদার ডেয়ারি’, ‘ফান মানচ’, ‘ডানলপ’, ‘পিয়ারলেস’, ‘ব্রুক বন্ড’, ‘কোয়ালিটি’-এর কালজয়ী বিজ্ঞাপন। যার ক্যাচলাইনে এখনও বুঁদ দর্শক।
কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ জীবনভর এসেছে বহু পুরস্কার ও সম্মান। ক্যালকাটা অ্যাডভার্টাইজিং ক্লাবের ‘হল অব ফেম’-এ অন্তর্ভুক্ত হয় তাঁর নাম। নিজের দীর্ঘ কেরিয়ারের প্রথম থেকেই তিনি ছিলেন এই ক্লাবের সদস্য।
আরও পড়ুন: লেকটাউনে বাইকবাহিনীর তাণ্ডব, তৃণমূল কার্যালয়ে ভাঙচুর
সৃজনশীলতার সঙ্গে তাঁর ব্যবসায়িক বুদ্ধিকেও কুর্নিশ জানাচ্ছেন বিজ্ঞাপন জগতের আর এক নাম সুতীর্থ সরকার। জানালেন, তাঁর পরামর্শেই পাঁচ টাকার পাউচ প্যাকে সর্ষের তেল বাজারে আনে এক নামী সংস্থা। চূড়ান্ত সফল হয় সেই উদ্যোগ। রাম রে-এর কথাতেই নিজেদের পণ্যের দাম কম রাখার ইউএসপি গ্রহণ করে কলকাতার জুতো প্রস্তুতকারী সংস্থা। এমনকি, কলকাতায় এক কামরার স্টুডিয়ো অ্যাপার্টমেন্ট জনপ্রিয় করার পিছনে ছিল তাঁরই বুদ্ধি। রাম রে-এর সঙ্গে কাজ করার দীর্ঘ স্মৃতিভাণ্ডার থেকে টুকরো টুকরো খণ্ডচিত্র এ ভাবেই তুলে ধরলেন তিনি।
তবে তাঁর স্মৃতি রোমন্থন অসম্পূর্ণ খাবারের কথা ছাড়া। ছিলেন অসম্ভব ভোজনরসিক। কাজের মাঝে তাঁর বিকেলের হাল্কা খাবার ছিল একসঙ্গে বারোটা শিঙাড়া! একবার নাকি নিজের জন্য রেস্তোরাঁয় অর্ডার করে বসেছিলেন প্রায় তেরো রকম পদ!
ডাক্তারি বিধিনিষেধকে গুরুত্ব না দেওয়া মানুষটা ছিলেন কলকাতার বিজ্ঞাপন দুনিয়ায় বটগাছের মতো। খাস আমেরিকায় জেডব্লুটি-র মতো সংস্থার প্রধান ছিলেন তিনি। যে কোনও বাঙালির কাছে এই কৃতিত্ব বিরল, মনে করেন তাঁরই হাতে তৈরি বি়জ্ঞাপন জগতের আর এক নাম কাঞ্চন দত্ত-ও। তাঁর মতে, রাম রে সযত্নে লালনপালন করেছেন কলকাতার বিজ্ঞাপন দুনিয়াকে।
নিজের হাতে তৈরি করেছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ঋতুপর্ণ ঘোষ। দশ বছর রেসপন্স-এ কর্মরত ছিলেন ঋতুপর্ণ। তাঁর সংস্থায় থাকার সময়েই ঋতুপর্ণ ঘোষ মার্গো সাবানের জন্য লিখেছিলেন ‘দেখতে খারাপ, মাখতে ভাল’ বা বোরোলিনের জন্য ‘জীবনের নানা ওঠাপড়া যেন সহজে গায়ে না লাগে’। ‘রেসপন্স’-এর বিজ্ঞাপন মানেই নজরকাড়া ক্যাচলাইন। সেই ধারা বজায় রয়েছে বরাবর। গুঁড়ো মশলার বিজ্ঞাপনে এসেছে ‘যোগ করলে গুণে বাড়ে’-র মতো লাইন। আবার, রিয়েল এস্টেটের বিজ্ঞাপনে দেখা গিয়েছে ‘সাধ্যের মধ্যে সিদ্ধালাভ’।
নিঃসঙ্কোচে রাম রে জানিয়েছেন, তিনি যেমন শিখিয়েছেন, ঋতুপর্ণর কাছ থেকে শিখেওছেন অনেক কিছু। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শিখতে চান। কাজ করে যেতে চান। ভাগ করতে চান নিজের অভিজ্ঞতা। এটাই ছিল এই পথ প্রদর্শকের জীবনের মূলমন্ত্র। থেমে গেল সেই পথ চলা। কিন্তু থামল না তাঁর শেখানো চরৈবেতি মন্ত্র।
রাম রে চলে গেলেন। রেখে গেলেন স্ত্রী, একমাত্র কন্যা, অগণিত গুণমুগ্ধ এবং অসংখ্য প্রজন্মজয়ী বিজ্ঞাপন।