পরিচর্যা: পোষ্যকে নিয়ে পথে। নিজস্ব চিত্র
লকডাউন উঠেছে প্রায় তিন মাস। সব কিছুই স্বাভাবিক হওয়ার পথে। কিন্তু প্রবল শ্বাসকষ্টে ভোগা অসুস্থ কুকুরটিকে কিছুতেই বাড়ি গিয়ে দেখে আসতে রাজি হচ্ছেন না নামী পশু চিকিৎসক। শেষে শর্ত দিলেন, যাঁর বাড়ির কুকুর তিনি গাড়ি পাঠালে যাওয়ার কথা ভেবে দেখতে পারেন! সন্তানসম পোষ্যের চিকিৎসার জন্য এটুকু করা কোনও ব্যাপার!
পোষ্যের মালিকের গাড়িতে চেপেই চিকিৎসক এলেন। পোষ্যটিকে পরীক্ষাও করলেন। কিন্তু কুকুরের শ্বাসকষ্ট সারল না। এ বার চিকিৎসক বললেন, ‘‘এতটা রাস্তা তো বাসে বা মেট্রো করে ফেরা যাবে না! আপনাদের গাড়ি আমায় বাড়িতে নামিয়ে দিলে সেখানে থাকা একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার চালকের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিতে পারি!’’ রাজি হলেন পোষ্যের মালিক। কিন্তু চিকিৎসককে নামিয়ে গাড়ি ফিরল খালি হাতেই। সেই দিনই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যু হল কুকুরটির।
অভিযোগ, গাড়ি থেকে নামার সময়ে চিকিৎসক বলেছিলেন, ‘‘ভাবলাম, আপনাদের সিলিন্ডার দিয়ে দিলে আমার চেম্বারে যাঁরা আসবেন, তাঁদের কী দিয়ে দেখব!’’
অসুস্থ কুকুরের চিকিৎসা করার চেয়ে ব্যক্তিগত চেম্বার চালু রাখাই শহরের পশু চিকিৎসকদের বড় অংশের এই মুহূর্তের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে অভিযোগ। কেউ আবার স্পষ্ট বলে দিচ্ছেন প্রিয় পোষ্যটিকে নিয়ে ব্যক্তিগত চেম্বারে দেখাতে গেলেই সেটির চিকিৎসা মিলবে! সংশ্লিষ্ট পশু চিকিৎসকের চেম্বার ছাড়া অন্য কোনও ল্যাবে পোষ্যের শারীরিক পরীক্ষা করালেও রিপোর্ট গণ্য করা হবে না। অভিযোগ, চিকিৎসক এমন ওষুধই দিচ্ছেন, যা শুধু ওই চিকিৎসকের চেম্বারেই মিলবে। পোষ্য কী খাবে, কোথায় নখ কাটবে, তা-ও বলে দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। তাঁর কথা না শুনলে পোষ্যের চিকিৎসাও তিনি করবেন না!
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তাঁর বলা সংস্থার পণ্য ব্যবহার করলে চিকিৎসকেরাও লাভের ভাগ পান। কুকুরের প্রজননও করাতে হবে পশু চিকিৎসকের কথা মতোই! অভিযোগ, বহু চিকিৎসক স্পষ্ট বলে দিচ্ছেন ‘‘আমি জায়গা বলে দিয়ে টাকা নেব ঠিকই, কিন্তু যে কোনও জায়গায় প্রজননের জন্য নিয়ে গেলে সংক্রমণ হবে। তখন তো আমাকেই চিকিৎসার খরচ দিতে হবে!’’
এক ভুক্তভোগীর দাবি, ‘‘পম প্রজাতির একটি কুকুর রাস্তায় পেয়েছিলাম। পরিচিত পশু চিকিৎসক দেখেই দ্রুত সেটিকে প্রজনন করাতে হবে বলে জানান। বাচ্চা হওয়ার পরে কুকুরের শরীর আরও ভেঙে গেল। কয়েক মাসেই সব শেষে। পরে বুঝেছি, কুকুরটার অনেক বয়েস হয়েছিল। মনে আছে, প্রজননের জন্য দেওয়া একটা তারিখে যেতে না পারায় চিকিৎসকের সে কী রাগ! আসলে সবটাই লাভের গুড়ের ভাগ পাওয়ার জন্য।’’
অভিনেতা তথাগত মুখোপাধ্যায় আবার জানান, তাঁর পরিচিত এক অভিনেত্রীর ১৫ দিনের কুকুরছানাকে চিকেন স্টক খাওয়াতে বলেছিলেন চিকিৎসক। তথাগতের কথায়, ‘‘খাওয়ার পর থেকে শুধুই বমি করছে সে! অবাক করা ব্যাপার, ১৫ দিনের কুকুরছানাকে চিকেন স্টক খাওয়ালে কী হতে পারে তা, চিকিৎসক জানেন না!’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘আমারই
চার মাস বয়সের কুকুর অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিল। চিকিৎসক কুকুরের ডিম্বাশয় বাদ দিয়ে দিলেন। অস্ত্রোপচারের পরে দেখা গেল, ভ্রূণ এসে গিয়েছে। এর পরে ভ্রূণ বাদ দিতে গিয়ে এমন অবস্থা করলেন যে সারা রাত রক্তপাত হয়ে কুকুরটি মারা গেল! বুঝে চিকিৎসা করছেন, এমন লোক পাওয়াই কঠিন। উল্টে খাবারের নাম বলে দেওয়ার জন্য টাকা নেবেন, এমন ওষুধ দেবেন যাতে তা খেয়ে ফের তাঁরই দ্বারস্থ হতে হয়। পোষ্যেরা তো কথা বলতে পারে না, চিকিৎসকদের কাছে তাই ওরাই গিনিপিগ!’’ বালিগঞ্জের সুলেখা কর্মকারের আবার দাবি, ‘‘দেশি বেড়াল তো আরও জায়গা পায় না। বেড়ালের সহ্যশক্তি বেশি বলে আঘাতের জায়গায় স্রেফ কাপড় মুড়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।’’
সল্টলেকের বাসিন্দা ডোনা কাঞ্জিলালের আবার দাবি, ‘‘ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাওয়া এক পোষ্যকে নিয়ে চিকিৎসকদের দোরে দোরে ঘুরতে হয়েছে পুজোর সময়ে টানা দু’মাস। কেউ বাড়ি এসে দেখতে চাননি। বলে দেওয়া হয়েছে, ন’বছর বয়স হয়ে গিয়েছে। হাল ছেড়ে দিন!’’
পশু চিকিৎসক অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় যদিও বললেন, ‘‘করোনার জেরে অনেক চিকিৎসকই বাড়ি গিয়ে দেখার সাহস করে উঠতে পারছেন না। সে কারণে এমন হলেও হয়ে থাকতে পারে! আর একটি কারণ অ্যাপ-ক্যাব সংস্থাগুলি পোষ্য তুলতে চায় না। পশুদের নিয়ে যাওয়ার ক্যাব পরিষেবাও অপ্রতুল। জরুরি সময়ে সে কারণেও বহু পোষ্য চিকিৎসা পায় না। তবে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে রাজ্য ভেটেরিনারি কাউন্সিলে জানানো যেতে পারে।’’ কাউন্সিলের সভাপতি জওহরলাল চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘লিখিত ভাবে বা মেল করে জানালে এই ধরনের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কাউন্সিলের গাফিলতি নেই।’’
কিন্তু পশুপ্রেমীদের বক্তব্য, ‘‘হাজার হাজার অভিযোগ জমাই পড়ে থাকে। সুরাহা হবে কবে?’’ এ প্রশ্নের অবশ্য স্পষ্ট উত্তর নেই কারও কাছেই।
(চলবে)