কাঁকুড়গাছির সুভাষ মেলায় উপচে পড়া ভিড়। সেখানেও দেখা গেল একই চিত্র। রবিবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
কলকাতা কি করোনা-শূন্য হয়ে গিয়েছে?
গত ২৩ বা ২৬ জানুয়ারি থেকে শহরে শুরু হওয়া মেলার ভিড় ঘিরে এই প্রশ্নই উঠে গিয়েছে। অভিযোগ, সেই সব মেলার কোনওটিতেই দূরত্ব-বিধি মানার বালাই নেই। বেশির ভাগ জায়গাতেই চোখে পড়ছে না মাস্ক পরে বিপদ এড়ানোর চেষ্টাও। চিকিৎসকেরা যা দেখে বলছেন, ‘‘করোনা-মুক্তির কোনও ঘোষণা কিন্তু হয়নি এখনও। এমন বেপরোয়া উৎসব-যাপনের জন্য যেন গায়ে জ্বর, পেটে খিদে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে না হয়!’’
চিকিৎসকদের এমন সতর্কবাণী আদৌ কানে ওঠে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। সেপ্টেম্বরে হু হু করে করোনা আক্রান্তের সংখ্যাবৃদ্ধি হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই ছিলেন অকুতোভয়। পুজোর আগে কেনাকাটার ভিড় দেখে আসরে নামতে হয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টকে। তার পরেও বর্ষশেষ ও বর্ষবরণের বেপরোয়া উৎসবে লাগাম পড়েনি। একই চিত্র ২৩ বা ২৬ তারিখ থেকে শুরু হওয়া মেলা ঘিরে। বৌবাজার চত্বরের একটি মেলার উদ্যোক্তা ঘোষণাই করে রেখেছেন, ‘‘করোনা তো কী? খেলে শরীর ভাল থাকে। তাই খাদ্যমেলা চলবে।’’
চলতি বছরে সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিনে শুরু হওয়া কাঁকুড়গাছির একটি মেলার উদ্যোক্তারা আবার মাসখানেক ধরে মেলা চলবে জানিয়ে একের পর এক গেট করেছেন রাস্তা জুড়ে। ওই ধরনের গেট লাগানো যে কলকাতা পুলিশ এলাকায় নিষিদ্ধ, সেই প্রশ্নও মনে থাকে না তাঁদের।
এমনই নিয়ম উড়িয়ে মেলা চলছে উত্তর থেকে দক্ষিণে শহরের বহু জায়গায়। এর মধ্যেই সরকারি হস্তশিল্প মেলাও চালু রয়েছে নিউ টাউনে।
দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা গেল, প্রবল ভিড়। গেট পেরিয়ে মেলায় প্রবেশ করতে হলে ছোঁয়াচ এড়ানোর উপায় নেই। অনেকেরই মাস্ক পরার বালাই নেই। মেলায় খাবারের স্টলগুলির সামনের পরিস্থিতি তো আরও ভয়ঙ্কর। সেখানেই দাঁড়ানো মাস্কহীন কয়েক জনের বক্তব্য, ‘‘করোনা এখন পকেটে। অকারণ করোনাকে নিয়ে ভয় করে বসে থাকব কেন?’’ কাঁকুড়গাছির মেলার ভিড় আবার সোজা চলে গিয়েছে সিআইটি রোড পর্যন্ত। অনেকেই মাস্ক পরার কথা ভুলেছেন। প্রশ্ন করায় সোনালি ঘোষ নামে এক তরুণী বললেন, ‘‘এই পাড়াতেই তো আমাদের বাড়ি। পাড়ার লোকের আবার মাস্ক লাগে নাকি!’’ মেলার একটি ‘জয়রাইডের’ সামনে দাঁড়ানো মৃদুলা ঘোষ আবার বললেন, ‘‘ডিসেম্বরেই করোনা থেকে সেরে উঠেছি। অ্যান্টিবডির জোরেই বেরিয়ে পড়েছি।’’ এই মেলার আয়োজকদের তরফে পরেশ পাল বলেন, ‘‘মেলা তো মানুষেরই জন্য।’’
সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের খাদ্যমেলায় পিঠে খেতে ব্যস্ত, পেশায় স্কুলশিক্ষক তন্ময় সাঁতরার আবার মন্তব্য, ‘‘করোনা করোনা করে এক বছর প্রায় স্কুল বন্ধ করে রাখল। কিছু তো বিনোদন দরকার। তাই খেতে চলে এসেছি। তা ছাড়া মেলা ছাড়া কলকাতার শীত কাটে নাকি?’’
চিকিৎসক কুণাল সরকার যদিও বলছেন, ‘‘করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা কিছুটা কমেছে ঠিকই, কিন্তু আমরা করোনা-মুক্ত হইনি। কলকাতাও করোনা-শূন্য হয়নি। তার চেয়েও বড় কথা, কী করে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কমল, আমরা কেউ জানি না। ফলে যা জানি না, তার জোরে বেরিয়ে পড়া চূড়ান্ত বোকামি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ভ্যাকসিনের জোরে অনেকে বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যে হারে ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে, তাতে দেশের সকলের কাছে ভ্যাকসিন পৌঁছতে কিন্তু ১২ বছর লেগে যাবে।’’
শিশু-রোগ চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ আবার বললেন, ‘‘অন্যান্য সমস্যা নিয়ে আসা বহু শিশুর দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে দেখছি। কিন্তু পরিবার জানাচ্ছে, বড়দের কয়েক জনের করোনা হলেও শিশুটির কোনও লক্ষণ না থাকায় তাঁরা তার করোনা পরীক্ষা করাননি। তা হলে ভাবুন, শিশুটির কখন করোনা হল, কখন সেরে গেল কেউ জানেন না! এমন শিশুর সংস্পর্শে এসে কত জন সংক্রমিত হলেন, তারও কোনও হিসেব নেই। বাচ্চাদের জন্যই কিন্তু অনেক অভিভাবক মেলায় যান। ফলে কে, কখন, কী ভাবে সংক্রমিত হবেন, কেউই জানেন না।’’
চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার এই পরিপ্রেক্ষিতেই বললেন, ‘‘এই অজানা পরিস্থিতির জন্যই তো মাস্ক পরে থাকতে বলা, দূরত্ব-বিধি মেনে চলতে বলা।’’
তাতে কাজ হয় কী? মেলার ভিড় কিন্তু অন্য কথাই বলছে।