বাস্তব: কন্টেনমেন্ট জ়োন নামেই! দূরত্ব-বিধি মানার বালাই নেই, অধিকাংশের মাস্কও নেমে এসেছে থুতনিতে। বুধবার, টেগোর ক্যাসেল স্ট্রিটের একটি বাজারে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
একাধিক আনলক-পর্বের পরে ফের সার্বিক লকডাউন হচ্ছে, আজ বৃহস্পতিবার। শহরবাসীর একাংশের বেপরোয়া মনোভাবের জন্যই কন্টেনমেন্ট জ়োন ঘোষণার পরিবর্তে আবার লকডাউনের পথে হাঁটতে হচ্ছে প্রশাসনকে— এমনটাই মনে করছেন চিকিৎসক থেকে পুলিশ-প্রশাসনের বড় অংশ। লকডাউন শুরুর আগে, বুধবার শহরের কন্টেনমেন্ট জ়োনগুলি ঘুরে দেখা গেল, সেই বিধিভঙ্গেরই পুরনো চিত্র!
• মাস্ক কিছুতেই মুখে থাকে না
প্রথম দফার লকডাউনের চার মাস পরেও মাস্ক পরার দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় না শহরের সর্বত্র। বেলেঘাটার চালপট্টি রোডের কন্টেনমেন্ট জ়োনে মাস্ক ছাড়া হেঁটে যাওয়া তমাল ঘোষ বললেন, ‘‘আমি মাস্ক পরলেই লকডাউন হবে না?’’ পোস্তার শিকদারপাড়া স্ট্রিটের বাসিন্দা স্নেহময় কর্মকারের আবার বক্তব্য, ‘‘মাস্ক পরে যাইনি বলে ওষুধের দোকান ফিরিয়ে দিল। এই বাড়াবাড়ি ক’দিন থাকে, দেখব।’’ সন্তোষপুর সম্মিলনী পার্কের কন্টেনমেন্ট জ়োনে মাস্ক ছাড়াই মোটরবাইকে সওয়ার সঞ্জয় দত্ত নামে এক ব্যক্তির আবার দাবি, ‘‘বাইক চালালে করোনা নাকে যায় না। জোরে হাওয়া দেয় তো!’’
• দূরত্ব-বিধি এখনও দূরের বিষয়
এ দিন চাঁদনি চক মার্কেটের ভিড় দেখে মালুম হয়, এখনও দূরত্ব-বিধি মানতে কতটা নিমরাজি শহর। গড়িয়াহাটের ভিড়ে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে ছিলেন উত্তম সামন্ত নামে এক ব্যক্তি। তাঁর যুক্তি, ‘‘দূরত্ব মানতে বললেই হল! রাস্তায় অত জায়গা কোথায়?’’ চেতলা রোডের কন্টেনমেন্ট জ়োনে বসে তাস খেলায় মত্ত এক ব্যক্তি বললেন, ‘‘এ সব খেলা দূরে বসে হয় না!’’ মানিকতলায় আবার দূরে দাঁড়াতে বলায় মুদি দোকানির সঙ্গে ঝগড়া করে চলে যাওয়ার সময়ে এক মহিলা বললেন, ‘‘দূরে দাঁড়াব কেন? আমার কি করোনা হয়েছে!’’
• বেলাগাম থুতু, পানের পিক
দমদম রোডের কন্টেনমেন্ট জ়োনের যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে কিছুটা দূরে বসে তিন প্রৌঢ়ের গল্প চলছিল ভাইরাস কী থেকে ছড়ায় তা নিয়ে। আলোচনার মাঝেই মাস্ক খুলে কান থেকে ঝুলতে শুরু করে এক জনের। মাস্ক মুখে নেই কেন? পাশে বসা আর এক জন মাস্ক নামিয়ে পানের পিক ফেলে বললেন, ‘‘এখন সব কিছু থেকেই করোনা ছড়ায়। মাস্ক রেখেও লাভ হবে না।’’ এই পানের পিক থেকেও...! কথা থামিয়ে প্রৌঢ়ের মন্তব্য, ‘‘অত ভয় পেলে বাড়ি থেকেই তো বেরোতাম না।’’
আরও পড়ুন: পুলিশে সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়ছে লকডাউনে
• বাজার করা চাই-ই চাই
শহরের বেশ কিছু বাজার সপ্তাহে তিন দিন করে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে প্রতিদিন বাজারে যাওয়ার অভ্যাস ছাড়তে পারেননি অনেকেই। উল্টোডাঙার একটি বাজারে দেখা গেল, মাস্ক ছাড়াই আনাজ নিয়ে বসেছেন তিন জন। সেখানে মাস্ক ছাড়াই হাজির দুই বয়স্ক ক্রেতা। এক জন অন্য জনকে হেসে বলছেন, ‘‘আজ ফের একটা বেগুন কিনতে হাজির?’’ অন্য জনের পাল্টা দাবি, ‘‘কিছু না কিছু নিতে রোজ আসতেই হয়। টাটকা আনাজ ছাড়া করোনার সঙ্গে লড়ব কী করে!’’ সুইনহো লেনের বাজারে এক মহিলা বললেন, ‘‘ছেলে-বৌমার ক’দিন ধরেই জ্বর। টাটকা মাছ নিয়ে গেলে একটু জোর পাবে।’’
• গণ-পরিবহণেও বিধি শিকেয়
হাজরা মোড়ে ছ’জন মাস্কহীন যাত্রী নেওয়া একটি ট্যাক্সিকে দাঁড় করিয়েছিল ট্র্যাফিক পুলিশ। চালকেরও মাস্ক নেই। তাঁর যুক্তি, ‘‘বাড়ির ঠিকানা দেখেই গাড়িতে তুলেছি। এঁরা কন্টেনমেন্ট জ়োনে থাকেন না।’’ জোড়াবাগান রুটের একটি অটোয় পাঁচ জন যাত্রী দেখে দাঁড় করায় পুলিশ। করোনায় মৃতের পরিবারের সদস্যেরা হাসপাতাল থেকে ফিরছেন শুনেই ছেড়ে দেন পুলিশকর্মী। বললেন, ‘‘ধরে থানায় নিয়ে গেলে নিজেদের বিপদ বাড়বে!’’
• পরিবারে করোনা, বাইরে আড্ডা
মতিলাল নেহরু রোডের কন্টেনমেন্ট জ়োনে গার্ডরেল দিয়ে ঘেরা আবাসনের সামনে দাঁড়িয়ে এক যুবক ফোনে বলছেন, ‘‘ক্লাবে ক্যারম খেলা শেষ। কী ওষুধ বলছিলে বলো, নিয়ে আসছি।’’ ওই যুবক বললেন, ‘‘মায়ের করোনা হয়েছে। ওষুধ আনতে যাচ্ছি। সারাক্ষণ বাড়িতে ভাল লাগে? তাই বিকেলে ক্লাবে যাই।’’
সার্বিক লকডাউনেও কি নিয়ম মেনে দায়িত্ব পালনে সচেতন হবেন না শহরবাসী? উত্তর মিলবে আগামী চব্বিশ ঘণ্টাতেই।
আরও পড়ুন: শহরকে ঘরবন্দি করতে বিশেষ বাহিনী নিয়ে তৈরি লালবাজার