লোভনীয়: জ়াকারিয়া স্ট্রিটে বাখরখানির সম্ভার। নিজস্ব চিত্র।
‘‘বড়দিনের কেক, গণেশ চতুর্থীর মোদক থেকে কুলচা, ভাটুরারও আজকাল দেখা মেলে মিষ্টির দোকানে! ইস, বাখরখানি কেন যে মেলে না!’’
মঙ্গলবার, রমজান শেষের ইদের বিকেলে খানিক দীর্ঘশ্বাসের সুরেই বলছিলেন নেতাজিনগরের বাসিন্দা শিবব্রত দাশগুপ্ত। পিছনের গোটা মাসটায় অন্তত বার চার-পাঁচ জ়াকারিয়া স্ট্রিট সফরের সুবাদে ‘রমজান স্পেশ্যাল’ বাখরখানির স্বাদটা এখনও তাঁর জিভে লেগে রয়েছে। পুরুষ্টু, গোলাকার রুটি বাইরে থেকে অনেকটা কুকির মতো। চাখলে পাউরুটির তুতো ভাই বলেও মনে হবে! নোনতা বা মিষ্টি, নানা রূপে তার অবতার। চা থেকে মাংসের ঝোলেও সে দিব্যি জুতসই! রাস্তা জুড়ে অস্থায়ী দোকানে ‘বাখরখানি’র স্তূপটা অনেকের চোখেই জ়াকারিয়া স্ট্রিটের প্রতীকের মর্যাদা পেয়ে গিয়েছে।
রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডে আরাফতের দোকানে দেখা গেল, গোলাকার, মুচমুচে রুটিগুলোকে অনেকেই শিরমল, বাখরখানি যা খুশি বলে ডাকছেন। বিকেল চারটেয় প্রকাণ্ড উনুনের ভাটি থেকে সদ্যোজাত এ স্বাদের আলাদাই মহিমা! কিন্তু পরেও মন্দ লাগে না! অনেকগুলো কাঠবাদাম-খচিত একটু বেশি দামের বাখরখানি ১২০ টাকাতেও বিকিয়েছে রমজানি কলকাতায়। জাফরানি রঙে উজ্জ্বল লখনউয়ি শিরমলের অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে, কলকাতার এই রমজানি রুটির সঙ্গে ফারাকটা তাঁরা সহজেই বুঝবেন!
আলিপুর কোর্টের আইনজীবী, একবালপুরের বাসিন্দা সাফিনা আহমেদ এই ইদ উপলক্ষেও বাড়িতে অতিথি আপ্যায়নে বিপুল পরিমাণ শিরমল বানিয়েছেন। তরিবত করে মাখা ময়দায় দুধ, ডিম, জাফরান— কত কী-ই যে মেশে! রেজ়ালা, কাবাবের সঙ্গতে মোটাসোটা নরম পরোটার জুড়ি নেই। বেকারির উনুনের ভাটির আগুনে স্নাত বাখরখানি বাড়িতে তৈরি ঢের কঠিন, মনে করেন সাফিনা।
কিন্তু কলকাতার জ়াকারিয়া স্ট্রিটের বাখরখানিকেও খাঁটির মর্যাদা দিতে আপত্তি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কন্যা, অধুনা হাওড়াবাসী হোম-শেফ তথা লেখিকা সামরান হুদার। খাঁটি বাখরখানি কলকাতায় দেখেছেন বলে তিনি মনে করতে পারেন না! সামরানের চোখে, ‘‘আসল বাখরখানি প্রায় প্যাটিসের মতো মুচমুচে। ভেঙে খেতে গেলে ঝুরঝুরিয়ে ভেঙে পড়বে!’’
ঢাকা বা নারায়ণগঞ্জের বাখরখানির সঙ্গে আবার জড়িয়ে ঢাকাই কুট্টিরা। ঢাকা ছেড়ে কোথাও গেলেও এ বস্তুটিকে তাঁরা চক্ষে হারান। সামরান বলছিলেন, বিস্কুটের মতো এ বস্তুটি চাইলে কয়েক মাস ধরেই একটু-একটু করে খাওয়া সম্ভব। প্রতুল মুখোপাধ্যায় গেয়েছেন, আলু বেচ, ছোলা বেচ, বেচ বাখরখানি/ বেচ না বেচ না বন্ধু তোমার চোখের মণি! বাঙালির বাখরখানি-রোম্যান্স মিশে এ গানে।
বুদ্ধদেব বসুর ‘গোলাপ কেন কালো’ উপন্যাসে আবার কল্লু মিয়াঁর খাস্তা বাখরখানি পান্তুয়া বা চিনিতে রসানো বাদামযোগে খাওয়ার ফিরিস্তি। উপরটা মুচমুচে হলেও কল্লুর বাখরখানি নাকি ভিতরে ‘মোলায়েম সারবান’, বলেছিলেন বুদ্ধদেব। এই বর্ণনা সামরানের ঢাকাই বাখরখানির অভিজ্ঞতার সঙ্গে পুরো মেলে না। কিন্তু রমজান শেষে বাখরখানির আশায় অনেকেরই প্রাণ আনচান।
কলকাতার মিষ্টির দোকানে ঢাকাই পরোটা, রাধাবল্লভি, ডালপুরি— কত কিছুর দেখা মিললেও এখনও ব্রাত্য বাখরখানি। কেউ কেউ বলছেন, লোকে চাইলে বাখরখানি পাওয়াও অসম্ভব নয়। তবে একবালপুরের কিছু ছোট বেকারির হুগলি-হাওড়ার কারিগরদের আশ্বাস, চাইলে বাখরখানির বন্দোবস্ত তাঁরা করে দেবেন! তা হোক, ছোলা, আলুর মতো বাজারে সুলভ হওয়াটা বাখরখানির জন্য এখনও দূর অস্ত্!