ন্যাশনাল মেডিক্যালে ব্যান্ডেজ ছাড়া কিছুই পায়নি প্রিন্স দাস। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
তাঁরা চান চিকিৎসা। কিন্তু সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মিলছে কেবল তারিখের পর তারিখ। এমনই অভিযোগ শহরের বেশির ভাগ সরকারি হাসপাতালে আসা রোগী এবং তাঁদের আত্মীয়দের।
বৃহস্পতিবার দুপুর ২টো নাগাদ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সির সামনে একাধিক রোগী প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে জানান, তিন মাস আগে আজকের তারিখ দেওয়া হয়েছিল। আজ চিকিৎসকেরা আবার অক্টোবর মাসের ২৪ তারিখে আসতে বলেছেন। তাঁদের সকলেরই প্রশ্ন, ‘চিকিৎসা কবে পাব?’
ভারতী মণ্ডল নামে তাঁদেরই এক জন জানান, তিনি এসেছেন সুন্দরবনের বরমোল্লা এলাকা থেকে। তিনি বলেন, ‘‘আমার টিউমার হয়েছে। আজ আলট্রাসোনোগ্রাফি করার কথা ছিল। তার পরে ডাক্তার দেখবেন, তেমনই কথা ছিল। কিন্তু ইউএসজি করতে গিয়ে জানতে পারলাম, ডাক্তার নেই। ইউএসজি হবে না। ইউএসজি-র রিপোর্ট না হলে ডাক্তার দেখবেন না। ফের অক্টোবর মাসের ২৪ তারিখে আসতে বলেছেন। এত দিন কী তা হলে আমার কোনও চিকিৎসা হবে না?’’ ভারতী মণ্ডলের পাশে দাঁড়িয়ে রহিম মণ্ডল জানান, তাঁর স্ত্রী আনজুমান খাতুনের হাতে টিউমার হয়েছে। এ দিন আলট্রাসোনোগ্রাফি না হওয়ায় চিকিৎসক দেখেননি। তাঁকে ফের আসতে বলা হয়েছে অক্টোবর মাসের ১০ তারিখে।
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দেখাতে আসা বেশ কিছু রোগীও এ দিন অভিযোগ করেন, তাঁরাও একের পর তারিখ পাচ্ছেন। চিকিৎসা অধরাই। সেখানকার ট্রমা কেয়ারের সামনে দেখা মিলল বিকাশ সিংহের। স্ট্রেচারে করে মা মনোরমা দেবীকে নিয়ে যাচ্ছিলেন বিকাশ। তিনি বলেন, ‘‘মা ক্যানসার রোগী। আর জি করের গোলমালের মধ্যে তিন বার এসে ফিরে গিয়েছি। কেমোথেরাপির ব্যবস্থা হয়নি। মায়ের পেট ফুলে গিয়েছে বলে আজ এসেছিলাম। কাল আসতে বলেছে।’’ অ্যাম্বুল্য়ান্সে উঠতে উঠতে আর এক রোগী শুভ দে-র মা শুক্লা দে বলেন, ‘‘অ্যাক্সিডেন্টে ছেলে মারাত্মক জখম হয়েছিল। ২৯ জুলাই ভর্তি করেছিলাম। আর জি করের ঘটনার মধ্যে এখানেই ছিল। ৪ সেপ্টেম্বর ছেড়ে দেয়। ওই সময়ের মধ্যে শুধু হাতের অস্ত্রোপচার হয়েছে। এখনও চিকিৎসা বাকি। আজ এসেছিলাম দেখাতে। ওর কলার বোন ভাঙা। ফের তিন সপ্তাহ পরে আসতে বলেছে।’’
বৃহস্পতিবার দুপুরে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্ট্রেচারে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল বছর আটের এক বালক। তার পায়ের গোড়ালি থেকে হাঁটুর উপর পর্যন্ত ব্যান্ডেজ জড়ানো। স্ট্রেচারে শোয়ানো ছেলেকে ধরে ফোনে তার বাবা বলে চলেছেন, ‘‘আর কত দিন এ ভাবে হাসপাতালে ফেলে রাখব! চিকিৎসা তো কিছুই হচ্ছে না।’’ তাঁর অভিযোগ, দু’দিন হাসপাতালে ভর্তি রেখেও ছেলের কয়েক টুকরো হয়ে যাওয়া পায়ের অস্ত্রোপচার তো দূর, ঠিক মতো চিকিৎসাও মিলছে না। ওই বালকের বাবা বিনোদ দাস জানালেন, দু’দিন আগে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছেলেকে ধাক্কা মারে একটি বেপরোয়া মোটরবাইক। দুর্ঘটনায় গোড়ালি থেকে হাঁটুর উপর পর্যন্ত কয়েক টুকরো হয়ে গিয়েছে। বিনোদের কথায়, ‘‘কলকাতায় নিয়ে এসে ছেলেকে ভর্তি করাতে পেরেছিলাম। কিন্তু তার পরে চিকিৎসা বলতে শুধু পায়ে ব্যান্ডেজ দেওয়া। অস্ত্রোপচার করে প্লেট বসাতে হবে কিনা, কিছু বলছে না চিকিৎসকেরা। শুধু বলছেন, ‘এখন ডাক্তার কম, তাড়াহুড়ো করলে অন্য জায়গায় নিয়ে যান’!’’ ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত দাদাকে নিয়ে একই রকম বিভ্রান্ত বিধান সাঁপুই। হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে বিধান বলেন,‘‘আমরা গরিব মানুষেরা যাব কোথায়?’’
এন আর এস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে জরুরি বিভাগ— ভোগান্তি সেখানেও। হাসপাতালে ফেলে না রেখে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার ‘পরামর্শ’ শুনতে হচ্ছে বলে রোগীর আত্মীয়দের অভিযোগ। বুধবার বিকেলে দুর্ঘটনায় মারাত্মক জখম হন গড়িয়ার বাসিন্দা সন্তোষ মল্লিক নামে এক যুবক। ই এম বাইপাসের বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে রাতে তাঁকে এন আর এসে নিয়ে আসেন আত্মীয়েরা। এ দিন দুপুরে জরুরি বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে যুবকের মা আশা মল্লিক বলেন, ‘‘রাতটা এখানে রাখতে পারলেও এখন অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে। কী করব জানি না।’’
রোগীর আত্মীয়দের অভিযোগ, জুনিয়র চিকিৎসকদের কর্মবিরতির জেরেই দুর্ভোগ বাড়ছে। আর জি করের নির্যাতিতার জন্য বিচার চান জানিয়ে জুনিয়র চিকিৎসকদের কাজে ফেরার আর্জি জানান তাঁরাও। যদিও হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, সিনিয়র চিকিৎসকেরা কাজ করছেন। পরিস্থিতি এখন
আগের থেকে ভাল। তবে বৃহস্পতিবার রাতে জুনিয়র চিকিৎসকেরা
কর্মবিরতি আংশিক প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।