সুহানা
দিন কয়েক আগে রাজ্যপালের দফতর থেকে বিষয়টি সম্পর্কে বিশদে জানতে চাওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য ভবনে। ‘মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’ও (এমসিআই) রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলেছে। মৃতার পরিবারের লোকেরা ধর্না দিয়ে পড়ে থাকছেন নবান্নে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তাঁদের তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ প্রমাণিত। কিন্তু এত কিছুর পরেও টনক নড়ছে না স্বাস্থ্যকর্তাদের। অভিযোগ প্রমাণের পরেও ন্যূনতম শাস্তি ছাড়াই কাজ করে চলেছেন এসএসকেএম হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের চার চিকিৎসক।
এসএসকেএমে রক্ত না পেয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে মারা গিয়েছিল এক কিশোরী। সেই ঘটনায় চার ডাক্তারকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল হাসপাতাল। কিন্তু তার পাঁচ মাস পরেও শাস্তি হয়নি সেই ডাক্তারদের। গোটা ঘটনায় স্বাস্থ্য দফতর, মেডিক্যাল কাউন্সিল এবং স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নীরবতা স্বাস্থ্য পরিষেবায় শৃঙ্খলারক্ষার বিষয়টি নিয়েই নানা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
গত ২৫ নভেম্বর উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগরের বাসিন্দা সুহানা ইয়াসমিন মণ্ডল স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে রড বোঝাই একটি গাড়ির ধাক্কায় গুরুতর জখম হয়। প্রথমে বসিরহাট এবং পরে কলকাতার আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে উপযুক্ত চিকিত্সা না মেলায় তাকে এসএসকেএমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই রাতে চার ইউনিট রক্ত লাগবে বলে সুহানার পরিবারের লোককে জানিয়েছিলেন ডাক্তারেরা। পরের দিন অর্থাত্, ২৬ নভেম্বর দুপুরে তা জোগাড়ও করে আনেন বাড়ির লোকেরা। কিন্তু পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় তা সুহানাকে দেওয়ার ‘সময় পাননি’ ডাক্তারেরা। রক্তের অভাবে ধুঁকতে ধুঁকতে মারা যায় ওই কিশোরী।
রাজ্যের সেরা সরকারি হাসপাতাল এসএসকেএমে এই ভাবে রোগী-মৃত্যুর ঘটনাকে ঘিরে তোলপাড় শুরু হয়েছিল নানা মহলে। ঘটনার এক দিনের মধ্যেই তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গড়া হয়। সেই কমিটিই চার জন জুনিয়র ডাক্তারকে এই ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করে। ওই চার জনই সেই ২৪ ঘণ্টায় ডিউটিতে ছিলেন। সেই তদন্ত রিপোর্ট স্বাস্থ্য ভবন, রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল ও স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু তার পরেও গত পাঁচ মাসে ওই চার চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এ ক্ষেত্রে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল প্রয়োজনে ডাক্তারদের সতর্ক করতে পারে। এমনকী, সাময়িক ভাবে রেজিস্ট্রেশন নম্বর বাতিলও করতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিষয়টি নিয়ে কোনও আলোচনাই হয়নি কাউন্সিলে। এমসিআই-এর নির্দেশ আসার পরে কী ভাবছেন কাউন্সিল কর্তারা? তাঁরা জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য দফতর কী ব্যবস্থা নেয়, তা দেখার পরেই এ ব্যাপারে এগোনো হবে। স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যত দূর মনে পড়ছে, আমরা স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এ ব্যাপারে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশই করেছি। দেখা যাক, ওরা কী করে।’’ যেহেতু ওই চার ডাক্তারই পোস্ট ডক্টরাল ট্রেনি, তাই তাঁরা স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এক্তিয়ার রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের। কিন্তু স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, তাদের আরও কিছুটা সময় লাগবে। তারা এখনও এ বিষয়ে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্তা বলেন, ‘‘ডাক্তারদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে গেলে নানা মহল থেকে চাপ আসবে। সেই কারণেই এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।’’
যদিও স্বাস্থ্যকর্তাদেরই একটা অংশ বলছে, এমন ঘটতে থাকলে সাধারণ মানুষ সরকারি ব্যবস্থায় আরও ভরসা হারাবেন। তাঁদের মনে হবে, চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ করা বা না করা, আদতে একই। কারণ অভিযোগ প্রমাণিত হলেও সুবিচার পাওয়ার আশা নেই।
সুহানার বাবা রুহুল আমিন মণ্ডল জানিয়েছেন, তিনি হাল ছাড়ছেন না। তিনি বলেন, ‘‘স্বাস্থ্য ভবনে গিয়ে দিনের পর দিন স্বাস্থ্যকর্তাদের ঘরের বাইরে বসে থেকেছি। কেউ দেখাই করছেন না। কিন্তু আমি হাল ছাড়ছি না। এর শেষ দেখে ছাড়ব।’’