শিক্ষিকাদের মধ্যে স্ত্রীরোগ যে হারে বেড়েছে, তাতে ‘আতঙ্কিত’ শিক্ষামন্ত্রী। বৃহস্পতিবার শিক্ষকদের এক অনুষ্ঠানে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের এ হেন ‘অসংবেদনশীল’ মন্তব্য উপস্থিত শিক্ষকদের হাততালি যেমন কুড়িয়েছে, তেমনই তুলেছে সমালোচনার ঝড়। কেউ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বিরোধীরা চক্রান্ত করে ইউটিআই ছড়াচ্ছে, এটাই এখন বলা বাকি রয়ে গিয়েছে!’ কেউ আবার বন্ধুদের হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে লিখেছেন— ‘যেমন রুচিবোধ, তেমনই মন্তব্য।’ কেউ আবার এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, ‘হাতে ক্ষমতা থাকলে যে মানুষকে ছোট করা যায়, এটা তারই আর একটি উদাহরণ।’
যে রাজ্যে ঋতুস্রাব চলাকালীন মহিলা কর্মীদের ছুটি দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে কোনও বেসরকারি সংস্থা, সেখানে নিজে শিক্ষামন্ত্রী হয়ে স্ত্রীরোগ নিয়ে প্রকাশ্যে এমন ‘অবমাননাকর’ মন্তব্য পার্থবাবু কী ভাবে করলেন, সেটাই ভাবাচ্ছে অনেককে। তবে লেখিকা বাণী বসুর উপলব্ধি, ‘‘মন্ত্রীদের কথাবার্তায় শালীনতার অভাব তো এই প্রথম নয়, আগেও দেখেছি। কিন্তু কোনও কোনও সময়ে সেই শালীনতার অভাব মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। পার্থবাবুর স্ত্রীরোগ-মন্তব্যেও অভাব রয়েছে সেই সংবেদনশীলতারই। তবে আস্তে আস্তে এমন কথা শুনতেও আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি।’’
এই ‘অভ্যস্ত’ হওয়ার কারণ, চারপাশের মানুষজনের মধ্যেই ছড়িয়ে রয়েছে অসংবেদনশীলতা এবং অশালীনতার বীজ। তৃণমূলের প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রীর ওই মন্তব্য হাসির রোল তুলে দিয়েছিল উপস্থিত শিক্ষকদের মধ্যে। হাততালিও কিছু কম পড়েনি। তবে ওই শিক্ষকেরা ব্যতিক্রম নন। তাঁদের মতো যে আরও অনেকে রয়েছেন, নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই তা বিলক্ষণ জানেন জলপাইগুড়ি গভর্নমেন্ট গার্লস হাইস্কুলের এক শিক্ষিকা। তিনি বলছেন, ‘‘আগে কো-এড স্কুলে পড়ানোর সময়ে দেখেছি, শারীরিক কারণে ছুটিছাটা নিলে কী ভাবে বাঁকা মন্তব্য করতেন পুরুষ সহকর্মীরা। অবসরের পরে বিকাশ ভবনে ছোটাছুটি করা শিক্ষিকাদেরও হামেশাই শুনতে হয়— চাকরিতে এত ছুটি নিয়েছেন কেন, তাই তো পেনশনে এত দেরি হচ্ছে!’’ এমনকি, এই অসংবেদনশীল মনোভাব সমাজের ভিতরে এতটাই ছড়িয়ে গিয়েছে যে, মহিলারাই অনেক সময়ে আর এক মহিলা সহকর্মীর শারীরিক সমস্যায় পাশে থাকেন না।
অথচ, বর্তমানে মেয়েদের মধ্যে ক্রমেই বাড়ছে স্ত্রীরোগজনিত সমস্যা। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, স্থূলতা, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, দূষিত পরিবেশ এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনের কারণেই স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে বিভিন্ন রোগ বাড়ছে। মহিলাদের উপরে এর প্রভাব পড়ছে মারাত্মক। অথচ, একাধিক স্কুল-কলেজের শৌচাগারে এখনও ন্যূনতম পরিচ্ছন্নতার বালাই নেই। সেই সব স্কুলে শৌচাগার ব্যবহার করাটাই ছাত্রীদের কাছে রীতিমতো ‘অভিশাপ’। ফলে স্কুলছুটের সংখ্যাও বাড়ছে। বাড়ছে ইউটিআই (ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন)-এর মতো সমস্যাও। কলেজশিক্ষিকা ও সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষ এই সমস্যার দিকেই নজর দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছেন। তাঁর সাফ কথা, ‘‘শিক্ষামন্ত্রীর কাছে জানতে চাইব, শিক্ষা ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অনুপাত সংক্রান্ত তথ্য তাঁর কাছে আছে কি না। বদলির দরখাস্তে স্ত্রীরোগের উল্লেখ বেশি থাকে কি না। আর যদি থাকে, তা হলে সেই সব স্কুল-কলেজে শিক্ষিকা ও ছাত্রীদের জন্য পরিচ্ছন্ন শৌচাগার রয়েছে কি না। শিক্ষিকাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ না করে তাঁদের কর্মক্ষেত্রে শৌচাগার তৈরি করে দেওয়ার কথা আগে ভাবুন।’’
অনেকেই বলছেন, শিক্ষকতার পেশায় মহিলারা বেশি আসেন বলেই এ ক্ষেত্রে স্ত্রীরোগে আক্রান্ত শিক্ষিকার সংখ্যা বেশি। অথচ, শিক্ষামন্ত্রী বড় অবলীলায় মন্তব্য করেছেন, ‘এত বেশি শিক্ষিকা কী করে স্ত্রীরোগে ভুগছেন জানি না! জেনুইন কিছু থাকলে নিশ্চয়ই বদলি হবে।’ কিন্তু কে বলবেন স্ত্রীরোগের দাবি কতটা সত্যি বা মিথ্যা? চিকিৎসকদের একাংশ বলছেন, এ সব ক্ষেত্রে অনেক সময়ে রোগীর কথার উপরে নির্ভর করতে হয় তাঁদের। স্ত্রীরোগ চিকিৎসক সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘জরায়ুতে টিউমার, সিস্ট, পলিসিস্টিক ওভারির মতো অসুখ কিছু পরীক্ষা করালেই সহজে ধরা পড়ে। কিন্তু ‘অ্যাবনর্মাল ইউটেরাইন ব্লিডিং’ অথবা ‘ডিসফাংশনাল ইউটেরাইন হেমারেজ’-এর মতো সমস্যা পুরোপুরি উপসর্গ-নির্ভর। এ সব ক্ষেত্রে রোগীদের কথার উপরে ভিত্তি করেই চিকিৎসা করি আমরা।’’