নলিন সরকার স্ট্রিট

রাস্তা জুড়ে পার্কিং, হাঁটাচলা করাই দায়

নলিন সরকার স্ট্রিটে আমাদের তিন পুরুষ ধরে যৌথ পরিবারের বাস। এখানেই ছোট থেকে বসু বাড়ির উঠোনে, পাড়ার অলিতে গলিতে ডাংগুলি, ক্রিকেট, ফুটবল, লুকোচুরি থেকে ব্যাডমিন্টন খেলায় হাতেখড়ি।

Advertisement

সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৫০
Share:

নলিন সরকার স্ট্রিটে আমাদের তিন পুরুষ ধরে যৌথ পরিবারের বাস। এখানেই ছোট থেকে বসু বাড়ির উঠোনে, পাড়ার অলিতে গলিতে ডাংগুলি, ক্রিকেট, ফুটবল, লুকোচুরি থেকে ব্যাডমিন্টন খেলায় হাতেখড়ি।

Advertisement

এক সময় প্রায় কুড়ি বাইশ জন ছেলেমেয়ে মিলে এই পাড়ার অলিগলিতে দাপিয়ে খেলে বেড়াতাম। জোর ছক্কা হাঁকিয়ে ক্রিকেটের বল উঠে যেত কারও ছাদে। সেই বাড়ির সামনে গিয়ে শুরু হত ঘ্যানঘ্যানানি। অনেক সময় ধাওয়া খেয়ে ফিরে আসতাম। আবার সেই বাড়ির জেঠিমাই বিজয়ায় ডেকে নিমকি, নাড়ু খাওয়াতেন। আত্মীয়ের বাইরে পাড়াতুতো সম্পর্কের সেই উষ্ণতাটা আজকাল বড় একটা চোখে পড়ে না।

এখন পাড়ার ছোটদের তেমন ভাবে খেলতে দেখি না। যদি বা তারা পাড়ায় বেরোয় মোবাইলেই মশগুল থাকে। আমাদের কাছে খেলাটা ছিল নিছক আনন্দ। এখন খেলাটাও কোচিং ক্লাস হয়ে গিয়েছে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে বিভিন্ন খেলা খেলতে খেলতে একদিন ব্যাডমিন্টনটা বেছে নিয়েছিলাম পেশাদার হিসাবে। আজকাল মা-বাবারা স্থির করে দেন, কাকে বড় হয়ে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় হতে হবে আর কাকে সাইনা নেহওয়াল। হয়তো সেই শিশুটি সাঁতারু হতে পারত বা গায়িকা। কিন্তু সেই স্বপ্ন দেখার আগেই তার জন্য লক্ষ্য স্থির করে দিচ্ছেন বাবা-মায়েরা। নষ্ট হচ্ছে ছোট ছেলেমেয়েদের নিজস্বতা আর ‘আত্ম-শিক্ষণ’।

Advertisement

ঘুড়ি এখানে উড়ত সারা বছর। বৈশাখ থেকে শুরু হত মাঞ্জা দেওয়া, হাত্তা মারা আর প্যাচ খেলায় হাত পাকানো। ছাদে-ছাদে কেটে যেত জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ। যখন বিশ্বকর্মা পুজো আসত তত দিনে দেখতাম রোদে ঝামা হয়ে সব বন্ধুর গায়ের রং দু’পোচ বসে গিয়েছে। দিন শেষে লাটাই গুটিয়ে যখন বাড়ি ঢুকতাম চুপিসারে, মা-কাকিমারা খেপাতেন— ‘ওই এলেন কালোমানিক’। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন খুব কান পেতে বসে থেকে হয়তো এক-দু’টো ‘ভোকাট্টা’ রব কখনও কানে আসে। কখনও তাও আসে না।

ছোটবেলায় পাড়ার পিতৃস্থানীয়দের যমের মতো ভয় পেতাম। সন্ধ্যা ছ’টায় খেলা শেষ করে বাড়ি ঢোকা ছিল অলিখিত নিয়ম। তার মধ্যেও নিয়ম ভেঙেছি। কিন্তু পাশের বাড়ির বড়রা যদি বেনিয়ম দেখে একটা হাঁক পাড়তেন তা হলে মাথা নিচু করে বকুনিটা শুনে নিতাম। সব সময় যে ভয়ে তা নয়, অনেকটাই শ্রদ্ধায়। সেই সব স্বেচ্ছা-অভিভাবকদেরই দেখেছি পরে আমার খেলা দেখতে দূর-দূরান্তে পৌঁছে যেতেন শুধু ভালবাসার টানে। এখন যদি দেখি পাড়ারই মুখচেনা বারো তেরো বছরের কোনও ছেলেমেয়ে এমন কিছু করছে যা ঠিক নয়, এগিয়ে নিষেধ করতে পারি না, সাহস পাই না। ভয় হয় যদি মুখের উপর বলে দেয় ‘আপনি বলার কে’। পিছিয়ে আসি। আসলে বড়-ছোট সম্পর্কের সামাজিক ধারণাটাই বদলে গিয়েছে।

এ পাড়ায় ছিল এইচএমভি-র ফাইনাল রিহার্সাল রুম। সেখানেও দেখতাম অনবরত সব তাবড় শিল্পীদের আসা-যাওয়া। কত বার দেখেছি পুজোর গানের ফাইনাল রিহার্সাল সেরে বড় গাড়িতে তাঁরা সোজা চলে যেতেন দমদমের স্টুডিওয় ফাইনাল রেকর্ডিং-এ। পাশের বাড়িতেই থাকতেন ছবি বিশ্বাস। নলিন সরকার স্ট্রিটের জলসাও এক সময় ছিল বিখ্যাত। পাড়ার লোক ছাড়াও আশপাশের সকলে সারা বছর অপেক্ষা করে থাকতেন। আলোচনা চলত বারান্দায়, রকে, চায়ের দোকানে— এ বার কোন কোন শিল্পী? সারা রাত ধরে চলত বিখ্যাতদের অনুষ্ঠান। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় — কাকে না দেখেছি সেই জলসায়। এখন সেই জলসা নেই তবে পাড়ায় বেশ কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এখনও হয়।

এই এলাকায় পুরসভা খুবই ভাল কাজ করে। নিয়মিত আবর্জনা পরিষ্কার করা, মশার তেল ছড়ানো এবং আরও নানা পুর-পরিষেবা নিয়ে তেমন কোনও অভিযোগ নেই এলাকাবাসীর। মনে আছে, আগে খুবই জল জমত। ইদানীং তা অনেক কমে গিয়েছে। কখনও ভারী বৃষ্টিতে কিছুটা জল জমলেও খুব তাড়াতাড়ি তা নেমে যায়। বর্তমান কাউন্সিলর এলাকায় প্রচুর সৌন্দর্যায়নের কাজ করেছেন। এই অঞ্চলে সবুজেও তেমন হাত পড়েনি। তাই গাছপালা নেহাত মন্দ নয়।

তবে এলাকার দু’টো বড় সমস্যা হল রাস্তার কুকুর আর পার্কিং। কুকুরের সংখ্যা ইদানীং অতিরিক্ত বেড়ে গিয়েছে। পাশেই হাতিবাগান বাজার থাকায় সারা দিন হকারদের চিৎকার, অগুনতি মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে। সঙ্গে সার দিয়ে পার্কিং করা বাইক আর গা়ড়ির জন্য মাঝে মধ্যে হাঁটাচলাই দায় হয়ে যায়। তার মধ্যেও বহু পুরনো থামওয়ালা বাড়ি, ঘুগনি গলির প্লেটে করে ধোঁয়া ওঠা গরম ঘুগনির গন্ধে এখনও সব মিলিয়ে এ পাড়ায় পুরনো কলকাতার সুবাস রয়ে গিয়েছে।

লেখক বিশিষ্ট ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement