বিতর্কের মুখে ওদেরই চিকিৎসা। নিজস্ব চিত্র
বেড়ালের জ্বর হয়েছিল। সঙ্গে প্রবল কাঁপুনি। নিরুপায় হয়ে পোষ্যের মালিক ফোন করেছিলেন বাড়ির কাছেই এক পশু চিকিৎসককে। তাঁর চেম্বারে তখন ভীষণ ভিড়। বেড়াল দেখতে যাওয়ার সময় নেই জানিয়ে ওই চিকিৎসক বলেন, তিনি তাঁর এক সহকারীকে (প্যারা-ভেট) পাঠিয়ে দিচ্ছেন। সহকারী এসে দাবি করলেন, তিনি এই পেশায় আছেন ১৫ বছর। এখন নিজে ডাক্তার।
ওই ব্যক্তি পরামর্শ দিলেন, বেড়ালের জ্বর নিয়ে চিন্তার কারণ নেই। মানুষের জন্য ব্যবহৃত ‘প্যারাসিটামল’ খাওয়ালেই হবে। তাঁর কথায় বিশ্বাস করে বাড়িতেই থাকা ওই ওষুধ পোষ্যকে খাওয়ালেন গৃহকর্তা। কিন্তু প্যারা-ভেট চলে যাওয়ার তিন ঘণ্টার মধ্যে চোখ বুজে এল তার। তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই মৃত্যু! ফোনে চিকিৎসককে সব জানাতে তিনি ক্ষমা চেয়ে বললেন, “উনি তো ডাক্তার নন, বুঝতে পারেননি!”
অভিযোগ, এ ভাবেই যখন খুশি, যেমন খুশি ওষুধ দিয়ে প্যারা-ভেটেরা শহরে রমরমা পশু চিকিৎসার ব্যবসা চালাচ্ছেন। চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনও রকম শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও তাঁরাই পশু চিকিৎসক হিসেবে চেম্বার খুলে বসছেন। সেখানে পশুর চিকিৎসা থেকে শুরু করে শারীরিক নানা পরীক্ষাও তাঁরা করছেন। অসুস্থ পোষ্যকে দেখছেন যিনি, তিনিই তার নখ কাটছেন। আবার তিনিই বলে দিচ্ছেন, পোষ্যকে কখন, কী খাওয়াতে হবে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এই ধরনের প্যারা-ভেটদের একটা বড় অংশেরই ন্যূনতম উচ্চ মাধ্যমিক পাশের শংসাপত্র নেই। এমনকি, ওঁদের হাত দিয়ে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই একের পর এক ওষুধ সস্তায় বিক্রি হচ্ছে।
সল্টলেকের এক বাসিন্দা বললেন, “আমার পোষ্যের কিডনির সমস্যার চিকিৎসা করাচ্ছিলাম এক পশু চিকিৎসকের কাছে। তিনি এক দিন এক প্যারা-ভেটকে ইঞ্জেকশন দিতে পাঠালেন। আসার সময়ে ওই ব্যক্তি জানালেন, নিজের চেম্বার থেকে সব নিয়ে আসছেন। বাইরে থেকে কিনতে গেলে খরচ বেশি পড়বে। ইঞ্জেকশন দিয়ে ওই প্যারা-ভেট বেরিয়ে যাওয়ার পরে পোষ্যের খিঁচুনি শুরু হল। আর বাঁচানো যায়নি।’’ ওই বাসিন্দা জানান, তিনি চিকিৎসককে পুরো ঘটনাটি জানালে তাঁর জবাব ছিল, ‘দু’টো ভায়াল থেকে দু’ধরনের ওষুধ একসঙ্গে একটা সিরিঞ্জে টেনে নিয়ে পোষ্যকে দেওয়ার কথা। বদলে আলাদা আলাদা করে দিয়েছেন প্যারা-ভেট। এতেই এমন হয়েছে! ওর চেম্বার বন্ধ করিয়ে দেব।’ কিন্তু, চেম্বার আর বন্ধ হয়নি।
রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে এমনই এক প্যারা-ভেটের চেম্বারে গিয়ে দেখা গেল, পোষ্যদের নিয়ে আসা মালিকদের ভিড়। আপনি পশু চিকিৎসক? প্রশ্ন শুনে প্যারা-ভেটের উত্তর, “চিকিৎসক না হলে এত লোক আমাকে দিয়ে তাঁদের পোষ্যের অস্ত্রোপচার করান? এই হাতে কারও ক্ষতি হয়নি। যাঁর হাত যত ভাল, চিকিৎসক হিসেবে তাঁর তত নাম।” পশু চিকিৎসার শংসাপত্র আছে? প্যারা-ভেট বললেন, “এক সময়ে সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলাম। ২০ বছর এই পেশায় আছি, সেটাই তো সার্টিফিকেট!”
পশু চিকিৎসক কৌস্তুভ বসু যদিও বলেন, “দীর্ঘদিন সহকারী হিসেবে কাজ করলেই কেউ কি পশু চিকিৎসক হয়ে যেতে পারেন নাকি? এঁরা শুধু কয়েকটা ওষুধের নাম জেনে রেখেছেন। কিন্তু কোনটা কোন রোগের ক্ষেত্রে দিতে হয় জানেন না। এঁদের হাতে তাই প্রায়ই পশু খুন চলছে।” কৌস্তুভবাবুর আরও অভিযোগ, একটি পোষ্যের প্রতিষেধক খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোন বয়সে কতটা ডোজ় দিতে হয়, তার স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু প্যারা-ভেটেরা একটা ডোজ় অনুমান করেই প্রতিষেধক দিয়ে দিচ্ছেন। আর এক পশু চিকিৎসক কৃষ্ণেন্দু পাল জানালেন, পশু চিকিৎসকদের সহকারী হিসেবে ‘লাইভস্টক ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট’ (এলডিএ) তৈরি করতে প্রশিক্ষণ দেয় রাজ্য সরকার। এর জন্য ন্যূনতম উচ্চ মাধ্যমিক পাশ হওয়া প্রয়োজন। তাঁর কথায়, “এই প্রশিক্ষণ নিয়েই যদি কেউ নিজেকে পশু চিকিৎসক ভাবেন, তার চেয়ে বড় অন্যায় কিছু নেই। শহরে তো বটেই, গ্রামে যে কত পশু এই ধরনের লোকের হাতে পড়ে মারা যাচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। গ্রামীণ অর্থনীতি এখনও অনেকটাই পশু-নির্ভর। দ্রুত এ জিনিস বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।’’
রাজ্য ভেটেরিনারি কাউন্সিলের সভাপতি জহরলাল চক্রবর্তী বলেন, “অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্য আমাদের নির্দিষ্ট কমিটিও আছে।’’ যদিও পশু চিকিৎসক স্বপন ঘোষের বক্তব্য, “অভিযোগ করবেন যাঁরা, অর্থাৎ পোষ্যের মালিকেরা কি নিজেরা সচেতন? নিজেদের বেলায় চিকিৎসকের খুঁটিনাটি জেনে দেখাতে যান তাঁরা। আর পোষ্যের বেলায় হাতের কাছে প্যারা-ভেট খোঁজেন?”
(শেষ)