যে শহরের ৪৫ লক্ষ জনসংখ্যার প্রায় ১৮ লক্ষই একটি ঘরে গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য হন, সেই শহরেই এক শ্রেণির মানুষ আবার তুলনামূলক ভাবে বড় আবাসন কিনতে চাইছেন। যাতে প্রয়োজনে অতিরিক্ত ঘর ব্যবহার করা যায়। আর এই চাহিদার পিছনে করোনা সংক্রমণজনিত মানসিক উদ্বেগ কাজ করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তবে তাঁরা এ-ও জানাচ্ছেন, আর্থিক এই বৈপরীত্য বরাবরই ছিল। সংক্রমণ তাকেই আরও প্রকট করে তুলেছে।
জনসংখ্যাবিদেরা জানাচ্ছেন, ২০১১ সালের জনগণনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তিনটি ঘর রয়েছে এমন ‘হাউসহোল্ড’-এর সংখ্যা শহরে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার ৫০৭। তিনটির বেশি ঘর রয়েছে, এমন হাউসহোল্ডের সংখ্যা ৯৪,৮৫৮। অর্থাৎ, তিনটি বা তার বেশি ঘর রয়েছে, শহরে এমন হাউসহোল্ডের সংখ্যা ২ লক্ষ ৪০ হাজার ৩৬৫। এক জনসংখ্যাবিদের কথায়, ‘‘আগে জনগণনায় হাউসহোল্ড শব্দটি পরিবার (ফ্যামিলি) হিসেবে উল্লেখিত হত। পরবর্তী সময়ে এর সহজ অর্থ দাঁড়ায়, এক ঠিকানায় বসবাসকারী।’’ পরিসংখ্যান বলছে, কলকাতায় ‘হাউসহোল্ড সাইজ়’ বা একই ঠিকানায় বসবাসকারী লোকের গড় সংখ্যা ৪.৩৮। সেই হিসেবে ৪৫ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে সাড়ে ১০ লক্ষ লোক (১০ লক্ষ ৫২ হাজার ৭৯৮) তিনটি বা বেশি ঘরে থাকার সুবিধা পান।
পরিসংখ্যানবিদেরা জানাচ্ছেন, এই সাড়ে ১০ লক্ষ নাগরিকের মধ্যেও ফারাক রয়েছে। ফারাকটি হল, নিজস্ব আবাসন বা বাড়ি এবং ভাড়াটে ও অন্যান্য বাসিন্দাদের। তিনটি বা তার বেশি ঘর রয়েছে, নিজস্ব বাড়ি বা আবাসনে থাকা এমন বাসিন্দার সংখ্যা ৮ লক্ষ ৭৪ হাজার ২৩০। আর ভাড়াটে বা অন্যত্র বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ১ লক্ষ ৭৮ হাজার ৫৬৮। এক পরিসংখ্যানবিদের কথায়, ‘‘সাড়ে ১০ লক্ষ লোক তিনটি বা তার বেশি ঘরে থাকার সুবিধা পান ঠিকই। কিন্তু এর অর্থ, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছেই থাকার মতো পর্যাপ্ত ঘর নেই। সীমিত সংখ্যক মানুষ, যাঁদের ক্রয়ক্ষমতা রয়েছে, তাঁরাই হয়তো তুলনামূলক ভাবে বড় আবাসন কিনতে চাইছেন।’’
আর এই প্রসঙ্গেই উঠে আসছে সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষার কথা। বেসরকারি সংস্থার ওই সমীক্ষা জানাচ্ছে, ২০১৯ সালে কলকাতায় কোনও আবাসনের গড় ‘বিল্ট আপ এরিয়া’ যেখানে ছিল এক হাজার বর্গফুট, সেখানে ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণ পরবর্তী সময়ে ১০ শতাংশ বেশি জায়গা চাইছেন ক্রেতারা। অর্থাৎ, ২০২০ সালে ক্রেতাদের চাহিদার শীর্ষে থাকা আবাসনের গড় জায়গা হল ১১০০ বর্গফুট। সমীক্ষাটি আরও জানাচ্ছে, কলকাতার পাশাপাশি মুম্বই, দিল্লি, বেঙ্গালুরু, পুণে, হায়দরাবাদ, চেন্নাইতেও ক্রেতাদের ঝোঁক বেশি জায়গার দিকেই।
সংশ্লিষ্ট সমীক্ষক সংস্থার চেয়ারম্যান অনুজ পুরি জানাচ্ছেন, ২০১৬ সাল থেকে আবাসন বা বাড়ির জায়গা ধারাবাহিক ভাবে কমেছে। সেখানে ২০২০ সাল ব্যতিক্রম। আবাসন নির্মাতা সংস্থাগুলির সংগঠন ক্রেডাই বেঙ্গলের কর্তা নন্দু বেলানিও বলছেন, ‘‘করোনার জেরে ক্রেতারা তুলনামূলক ভাবে বড় জায়গা পছন্দ করছেন।’’
যদিও অনেকের বক্তব্য, করোনা সংক্রমণ থেকে শিক্ষা নিয়ে দূরত্ব-বিধি বজায় রাখা বা আইসোলেশনে থাকার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে তার জন্য এই বাড়তি জায়গার ঝোঁক, না কি অন্য কোনও কারণ, তা খতিয়ে দেখা দরকার। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক অজিতাভ রায়চৌধুরী জানাচ্ছেন, আবাসন শিল্পের বিপণনের জন্য এই ধরনের সমীক্ষা করা হয়েই থাকে। ফলে সেটা কতটা বিজ্ঞানসম্মত, সেটা আগে দেখা প্রয়োজন। তাঁর কথায়, ‘‘কত সংখ্যক মানুষ এই বাড়তি বর্গফুটের আবাসন কেনার আগ্রহ প্রকাশ করছেন, সেটাও কিন্তু দেখতে হবে! সেই সংখ্যাটা তো মুষ্টিমেয়।’’ ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ-এর প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল নির্মল গঙ্গোপাধ্যায় আবার বলছেন, ‘‘করোনা সংক্রমণ আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রেই পরিবর্তন এনেছে। মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, এমনকি বাড়িতে কারও সর্দি-জ্বর হলেও পরিবারের অন্য সদস্যেরা একটু দূরে দূরে থাকছেন। তবে সেটা আবাসন কেনার ধারাতেও পরিবর্তন এনেছে কি না, তা আরও কিছু দিন গেলে স্পষ্ট হবে।’’