দর্শনার্থী: বাবার সঙ্গে হুইলচেয়ারে চেপে পুজোমণ্ডপে দেবস্মিতা
পুজোর বাকি কয়েক দিন। দুর্গাপুজো এলেই আমার খুব আনন্দ হয়। আলোর রোশনাইয়ে বদলে যায় এই শহরটা। দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশের জমকালো সাজ, অস্ত্র, বাহন― সব মিলিয়ে মনে হয়, যেন স্বর্গে পৌঁছে গিয়েছি। আমার সব থেকে আনন্দ হয় ঠাকুরের মূর্তি দেখে। তাই মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়াই।
আমাকে নিয়ে বেরোতে তো বাবা-মায়ের অনেক সমস্যা হয়, তাই ভিড় এড়াতে ঠাকুর দেখা একটু আগেই শুরু করি আমরা। কখনও বাবা, কখনও মা আমাকে হুইলচেয়ার ঠেলে নিয়ে যান। সেটা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে যখন হুইলচেয়ার চলে, তখন ঝাঁকুনিতে আমার সারা শরীর আর মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। বেশির ভাগ মণ্ডপে হুইলচেয়ার তোলা যায় না। তখন বাবা-মা মিলে হুইলচেয়ারের সামনে আর পিছনে ধরে মণ্ডপে ঢোকান। কিছু মণ্ডপে সিঁড়ি বেশি থাকে। এমন ক্ষেত্রে মা স্বেচ্ছাসেবীদের ডাকেন হুইলচেয়ার ধরতে। তিন-চার জন মিলে ধরাধরি করে সিঁড়ি পার করেন। সেই সময়ে আমার খুব ভয় করে। ওঁরা তো জানেন না যে আমার ঘাড়েও সমস্যা রয়েছে, তাই মাথা এক দিকে হেলে যায়। কিছু জায়গায় আবার হুইলচেয়ার তুলে দেওয়ার সুবিধেও থাকে না। তখন বাইরে থেকে দেখেই মন খারাপ নিয়ে ফিরতে হয়।
প্রতি বছর পুজোয় এ ভাবেই ৫০-৬০টা ঠাকুর দেখা হয়ে যায়। হুইলচেয়ারে বসে ভিড় সরিয়ে যখন ঠাকুরের সামনে যাই, মন ভরে ওঠে। বাবা বলেন, বড় রাস্তায় হুইলচেয়ার চালাতে অসুবিধে। তাই গলির ঠাকুরই বেশি দেখা হয়। মাঠে যে সব পুজো হয়, সেখানেও যাওয়া যায় না। হুইলচেয়ার ঠেলে নিয়ে যেতে খুব কষ্ট হয়। পুরস্কার পাওয়া বড় পুজো আমার দেখাই হয় না। ভিড় আর ট্র্যাফিক জ্যাম পেরিয়ে ওই সব মণ্ডপে ঠাকুরের কাছে পৌঁছতে পারি না। মেট্রোয় চড়ে যে ঠাকুর দেখব, সে উপায় নেই, কারণ বড্ড ভিড়। আমার মতো যাত্রীদের জন্য মেট্রো নয়। অথচ দিল্লির মুদিতা দিদি আমার মতোই হুইলচেয়ারে বসে রোজ মেট্রোয় কলেজে যায়।
আমাদের এখানে তেমনটা হয় না কেন মা? মা বলেন, শিশু-বয়স্ক বা অসুস্থ মানুষেরও যে ঠাকুর দেখতে ইচ্ছে করে সে কথা মণ্ডপ তৈরির সময়ে ওঁরা ভাবেন না। তাই ক্রাচ, হুইলচেয়ার বা ওয়াকার নিয়ে চলাফেরায় এত কষ্ট। একটা প্রশ্ন আছে আমার। যাঁদের হাঁটতে কষ্ট বা যাঁরা আমার মতো হুইলচেয়ারে ঘোরেন, তাঁদের জন্য কি আলাদা সময় রাখতে পারেন না কাকুরা?
তবে আবাসনের পুজোয় আমি আনন্দ করতে পারি। সেখানে ভিড় নেই, সিঁড়ি নেই। ওখানে নাচ-গানের অনুষ্ঠান হয়। পুজোর সময়ে বাইরে খেতে ভালবাসি আমি। যদিও প্রায় সব রেস্তরাঁয় ঢুকতেই সিঁড়ি ভাঙতে হয়। এ দিকে, আমাকে কোলে নিয়ে নিয়ে বাবার আজকাল কোমর ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। তাই খাওয়ার ইচ্ছে মনেই চেপে রাখি।
পুজোয় সব ইচ্ছে পূরণ না হলেও আনন্দে ভাসি আমি। অসুবিধের কথা মনে থাকে না তখন। শুধু মনে হয়, ঢাকের আওয়াজ, মা দুর্গা, তাঁর ছেলেমেয়ে, লুকিয়ে থাকা শিব ঠাকুর এবং আড়ালে থাকা কলাবৌ। আর আলোর রোশনাইয়ে ভেসে যাচ্ছে আমার শহর।
একটা কথা চুপিচুপি বলি। আজকাল আরও একটা ভয় হচ্ছে। আরও বড় হলে হুইলচেয়ারে বসে কি ঠাকুর দেখতে পারব? তখন এই কাকুরা কি ওটা তুলতে পারবেন? মা-বাবাও কি পারবেন আমাকে তুলে এক ধাপ করে সিঁড়ি পার করাতে?