বিতর্কের কেন্দ্রে এই সেই জমি।
আগের বার ছিল জালিয়াতি করে জমি কেনা-বেচার নালিশ। প্রাক্তন সিপিএম সাংসদের সেই দুই পরিজনের বিরুদ্ধেই এ বার জবরদস্তি জমি হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
নিউটাউনের থাকদাঁড়ির প্রবীণ বাসিন্দা পঞ্চানন প্রামাণিকের দাবি, তাঁকে সপুত্র তুলে নিয়ে গিয়ে জমির দলিলে জোর করে সই করিয়ে নিয়েছেন অরুণ মাহেশ্বরী ও অমিতাভ কেজরীবাল। অরুণ হলেন সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ সরলা মাহেশ্বরীর স্বামী, অমিতাভ তাঁর জামাই। ঘটনাটি সম্পর্কে আদালতের দেওয়া নির্দেশও স্থানীয় প্রশাসন মানছে না— এই অভিযোগ তুলে এখন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হয়েছেন পঞ্চাননবাবু। তিরাশি বছরের বৃদ্ধের কথায়, ‘‘শুনেছি, দিদি গরিবের পাশে দাঁড়ান। আমার সর্বস্ব যাঁরা কেড়ে নিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে উনি নিশ্চয়ই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন।”
এবং ওঁদের অভিযোগকে কার্যত মান্যতাই দিয়েছেন বিধাননগর পুরসভার ভাইস-চেয়ারম্যান তথা রাজারহাটের তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত। তাঁর বক্তব্য, ‘‘প্রামাণিক পরিবারের সঙ্গে সত্যিই অন্যায় হয়েছে। সিপিএম জমানায় জবরদস্তি জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আবার এ-ও ঠিক, আমাদের আমলে ওই জমি পুরসভায় অন্যায় ভাবে মিউটেশন করা হয়েছে।’’ অরুণ-অমিতাভ অবশ্য যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন। বাড়তি টাকা আদায়ের মতলবে প্রামাণিকেরা গল্প ফাঁদছে বলে পাল্টা তোপও দাগছে মাহেশ্বরী পরিবার।
অরুণ-অমিতাভ এর আগেও শিরোনাম হয়েছেন— জাল প্যানকার্ড দেখিয়ে জমি কেনার অভিযোগের সূত্রে। বছর কয়েক আগের সেই বৃত্তান্ত ঘিরে রাজ্য-রাজনীততে তোলপাড় হয়, যার জেরে মাহেশ্বরী দম্পতিকে দল থেকে সাসপেন্ড করে সিপিএম। তাঁদের বাড়ির একতলায় পার্টি অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়, এমনকী সিপিএমের হিন্দি মুখপত্রের প্রধানের পদও খোয়াতে হয় অরুণ মাহেশ্বরীকে। ঠিক কী হয়েছিল?
মাহেশ্বরীদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ এনেছিলেন এক দম্পতি— শঙ্কর ভট্টাচার্য ও প্রগতি ভট্টাচার্য। ওঁরা অরুণবাবুর সংস্থায় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে কাজ করেছেন ১৯৯৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত। ভট্টাচার্য দম্পতির দাবি, সেই সময়ে নানা অছিলায় তাঁদের দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নেওয়া হয়েছিল, যা দেখিয়ে তাঁদের নামে প্যানকার্ড ও পরিচয়পত্র বানিয়ে জমি কারবারের একটি কোম্পানি খোলা হয়। তার মাধ্যমে নিউটাউন-রাজারহাটে জমি কেনা-বেচা করা হয়েছে। অমিতাভ কেজরীবালের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ আনেন সন্তোষ সিংহ নামে এক গাড়িচালক।
এ সবের ভিত্তিতে ২০১২-র ১০ জুন বিধাননগর পুলিশ অরুণ ও অমিতাভকে গ্রেফতার করে। তাঁরা আপাতত জামিনে মুক্ত। প্রতারণার মামলাটি এখনও চলছে। তারই মধ্যে মাথা চাড়া দিয়েছে নতুন নালিশ। এ বারের অভিযোগকারী পঞ্চাননবাবুর দাবি, নিউটাউনের মহিষবাথান ও থাকদাঁড়ি মৌজায় তাঁদের মোট ১৮০ কাঠা জমি ছিল। মাহেশ্বরী-কেজরীবালদের ‘ক্যানপি’ কোম্পানি তার পুরোটাই জবরদস্তি কব্জা করে নিয়েছে। কী ভাবে?
বৃদ্ধ বলেন, ‘‘দিনটা ছিল ২০০৮-এর ২ ফেব্রুয়ারি। আমাকে দিয়ে জোর করে জমি বিক্রির কাগজে সই করিয়ে নেওয়া হল। জমির দাম হিসেবে যত টাকা দেবে বলেছিল, তা-ও দেয়নি।’’ পরে পঞ্চানন প্রামাণিকের হয়ে আরও কিছু জমি হস্তান্তরের জন্য জনৈক উত্পল মণ্ডলকে ‘পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি’ দেওয়া হচ্ছে— এই মর্মেও লিখিয়ে নেওয়া হয় বলে পরিবারের দাবি। প্রসঙ্গত, উৎপলবাবু ‘ক্যানপি’-রই কর্মচারী।
শয্যাশায়ী পঞ্চানন প্রামাণিক।
পঞ্চাননবাবুর ছেলে সুকুমারবাবু জানাচ্ছেন, প্রতিকার চেয়ে তাঁরা প্রথমে বারাসত আদালত, পরে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেন। আদালত ওই জমিতে আবাসন নির্মাণে স্থগিতাদেশ দিয়ে পুলিশকে তদন্ত করতে বলে। পরে বিধাননগরের তদানীন্তন এসডিও একই নির্দেশ দেন। ‘‘তবু পুলিশ হাত গুটিয়ে রয়েছে, আবাসনের কাজও চালু রয়েছে।’’— আক্ষেপ সুকুমারবাবুর। তিনি বলেন, “দলিলে লেখা ছিল, জমির দাম বাবদ প্রাপ্য টাকা বাবার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দেওয়া হবে। তা পাওয়া যায়নি। এর প্রমাণও কোর্টে পেশ করা হয়েছে।’’
এমতাবস্থায় পঞ্চাননবাবু পুরো বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীকে বিস্তারিত ভাবে জানিয়েছেন। ‘জমি মাফিয়ারা জোর করে আমার জমি কেড়ে নিয়েছে। তাদের সঙ্গে প্রশাসন ও পুরসভার যোগসাজশ থাকায় কোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও বিচার পাচ্ছি না। দয়া করে আপনি ব্যবস্থা নিন।”— মুখ্যমন্ত্রীকে আবেদন করেছেন তিনি। কিন্তু আপনি সই করলেন কেন?
থাকদাঁড়ির বাড়িতে বিছানায় শোয়া বৃদ্ধ বলেন, “ছেলেকে রিভলভারের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল! আমি প্রস্টেটের রোগী। অসুস্থ শরীর নিয়ে কী-ই বা করতে পারি!”
উল্টো দিকে মাহেশ্বরী পরিবার যেমন অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করছে, তেমন পুলিশও গাফিলতির কথা মানতে নারাজ। অমিতাভ কেজরীবালের দাবি, পঞ্চাননবাবু তখন স্বেচ্ছায় জমি বিক্রির দলিলে সই করেছিলেন। ‘‘গত ছ’বছরে ওই তল্লাটে জমির দর কয়েক গুণ বেড়েছে। এখন তাই অসত্ ভাবে বাড়তি টাকা আদায়ের চেষ্টা।’’— পর্যবেক্ষণ অমিতাভবাবুর। তাঁর এ-ও মন্তব্য, ‘‘পঞ্চাননবাবুর ইচ্ছেতেই উৎপলকে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দেওয়া হয়েছে।’’ যা শুনে প্রামাণিকদের পাল্টা প্রশ্ন— নিজের ছেলেদের বাদ দিয়ে বাইরের কাউকে পঞ্চাননবাবু খামোকা জমি বিক্রির ‘পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি’ দিতে যাবেন কেন?
যাঁর নামে পাওয়ার, তিনি কী বলেন?
টেলিফোনে প্রশ্নটি শুনেই উৎপলবাবুর জবাব, ‘‘আমি কিছু বলব না। এক জনকে দিচ্ছি, তাঁর সঙ্গে কথা বলুন।’’ ফোন ধরে সেই ব্যক্তি অমিতাভ কেজরীবাল হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘‘এ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না। যাঁরা নালিশ করেছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলুন।’’
পুর-কর্তৃপক্ষের কী বক্তব্য?
বিধাননগর পুরসভার চেয়ারপার্সন কৃষ্ণা চক্রবর্তীর প্রতিক্রিয়া, “এটা একেবারেই আইনি বিষয়। তবে আদালতের রায় ওই পরিবারের পক্ষে থাকলে বিরুদ্ধে কিছু করার প্রশ্নই ওঠে না।’’ পুর-প্রধানের আশ্বাস, ‘‘ওঁরা (প্রামাণিক পরিবার) আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে নিশ্চয়ই সাহায্য করার চেষ্টা করব।” মহিষবাথান-থাকদাঁড়ির ওই আবাসন প্রকল্পে গিয়ে কিন্তু দেখা গিয়েছে, পাঁচিল-ঘেরা জমিতে ফ্ল্যাট উঠছে জোরকদমে। কাছাকাছি যেতে চাইলে গেটে মোতায়েন রক্ষী পথ রুখেছেন। তবে বাইরে থেকে বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, কাজ অনেকটাই শেষ।
বিধাননগর কমিশনারেটের এক অফিসার অবশ্য বলছেন, “তদন্ত ঠিকই চলছে। আদালতের নির্দেশও আমরা অমান্য করিনি।”
— নিজস্ব চিত্র