রবিবাসরীয় পুজোর বাজার। হাতিবাগানে।
শহর জুড়ে যেন শপিং মরসুম। মহালয়ার আগের শেষ রোববারে ঠিক এমনটাই হওয়ার কথা ছিল বাজার-ফুটপাথ, শপিং মলগুলিতে। কিন্তু আঁখো দেখা হাল যেন একটু অন্য কথা বলছে। ভাল নেই ব্যবসায়ীরা। পুজোর এতটা কাছাকাছি রবিবাসরীয় বাজার যতটা চাঙ্গা হওয়ার কথা ছিল, তাতে যেন কোথাও একটু খামতি রয়েছে।
ভিড় আছে, নেই সেই উন্মাদনা। সেই উপচে পড়া, গায়ে-গা ঠেকে যাওয়া মারকাটারি ভিড়টা যেন মিস করছে রবি-বিকেলের শপিং পাড়াগুলো। হাতিবাগানের ফুটপাথ জোড়া বাহারি বাজারের সামনে দাঁড়িয়ে এমনটাই মনে হল। পোশাক ব্যবসায়ী রাজেশকুমার মাথুর জনা তিনেক খদ্দেরকে জামাকাপড় দেখাতে দেখাতে বললেন, ‘‘গত বার এ রকম রবিবারে এর দ্বিগুণ কাস্টমার সামলেছি।’’ সিটি গোল্ডের পসরা সাজিয়ে একা বসে থাকা গৌরাঙ্গ বসাক বললেন, ‘‘অনেক টাকা লাগিয়েছিলাম। পুজোর আগে আরও একটা শনি-রবি মিলবে। দেখা যাক...।’’
ফুটপাথ যদি বা কিছু ভিড় দেখছে, কার্যত মাছি তাড়াচ্ছেন ফুটপাথ-লাগোয়া পাকা দোকানগুলি। কিন্তু কেন এমন হল? অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাসের শেষ। তার উপরে সরকারি চাকুরিজীবিরা এখনও বোনাসের টাকা পাননি। সব মিলিয়ে বাজারমুখী ভিড়টা কমের দিকেই। তবে এ তো কেবল আজকের কথা। ‘পুজোর বাজার’ শব্দবন্ধটির গতিই শেষ কয়েক বছর ধরে একটু বদলাতে শুরু করেছে বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা। হাতিবাগানে ২০ বছর ধরে পোশাকের ব্যবসা করছেন বাপ্পা মণ্ডল। বললেন, ‘‘মানুষের সময় কমছে। ঘুরে, ঘেমে বাজার করার চেয়ে ফোনেই সব সারছেন। ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে সে সব। সারা বছরই চলছে কেনাকাটা।’’
এক মত গড়িয়াহাটেও। শহরের অন্যতম শপিং-ফুটপাথ হিসেবে পরিচিত গড়িয়াহাট বাজার উত্তর কলকাতার তুলনায় একটু চনমনে। তবু এর চেয়ে অন্তত ২০ শতাংশ বেশি ভিড় আশা করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। আর এই মন্দার কারণ হিসেবে অনলাইন শপিংকে অনেকটা দায়ী করলেন তাঁরা। ব্যাগের দোকানদার গোবিন্দ সাউ বলেন, ‘‘মাপ-রং-ডিজাইন সবই পছন্দ করার সুযোগ দিচ্ছে ওরা। কোনও অসুবিধা থাকলে বদলেও দিচ্ছে। এমনকী, টাকাও ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছে ওরা।’’
সঙ্গে আছে শপিং মলগুলিতে বছরভর রকমারি ছাড়। ফলে প্রয়োজন মতো চলছে কেনাকাটা। এমনটাই জানিয়ে বেসরকারি কর্মচারী অতনু বিশ্বাস বলেন, ‘‘পয়লা বৈশাখ হোক বা জন্মদিন, কেনাকাটা চলতেই থাকে। অধিকাংশ সময়েই মলগুলিতে একসঙ্গে একাধিক পোশাক কিনলে ছাড় পাওয়া যায়। সেটাই সুবিধাজনক। এক বারে পুজোর বাজারও হয়ে যায়।’’
পুজোর বাজার। নিউ মার্কেটে।
তবে সারা বছর শপিং মল আর অনলাইন চললেও, পুজোর সময়ে কিছু জিনিসের জন্য ফুটপাথের জবাব নেই, জানাচ্ছেন জেন ওয়াইয়ের প্রতিনিধি রিয়া দত্ত। আইটি সেক্টরে চাকরি করছেন তিনি। গড়িয়াহাটের বিখ্যাত ওড়না বিপণির মতো ডিজাইন ও রঙের সম্ভার পৃথিবীর কোথাও মেলা সম্ভব নয় বলে সাফ জানিয়ে দিলেন। সঙ্গিনী পারমিতাও বললেন, অনলাইনে ‘বাজিরাও মস্তানি’ আনারকলি মিলেছে। কিন্তু সঙ্গের ম্যাচিং করা জুয়েলারির জন্য গড়িয়াহাট ছাড়া কিছু ভাবতেই পারেন না।
তবে এ সব কিছুর মধ্যে পিছিয়ে নেই ব্যবসায়ীদের চিরকালীন রসিকতা। ‘‘কত দেবেন দিয়ে যান, নতুন জামা নিয়ে যান,’’ চিৎকার করছেন এক তরুণ ব্যবসায়ী। সুতির ছাপা শাড়ি-বিক্রেতার ইউএসপি, আজকাল দেড়শো টাকায় কালীঘাটে মায়ের মুখদর্শনও হয় না, আপনার বারো হাত শাড়ি হয়ে যাবে।’’ আর এ সব কিছুর পরে দরাদরি। ‘‘কত দেবে বলো’’ আর ‘‘কেনা দামও উঠছে না দিদি’’—এই দুইয়ের মাঝে হাজারে হাজারে জামা-জুতো-ব্যাগ-প্রসাধনী-গয়না বিকিয়ে গেল বিকেল জুড়ে।
তবে ঝিমিয়ে থাকা আর নিরাশার ছবিটা এক নিমেষে বদলে গেল ধর্মতলা চত্বরে পা রেখে। বারুইপুরের বসু পরিবার থেকে বারাসতের বসাক দম্পতি— একবাক্যে স্বীকার করে নিলেন, ‘সব বাজার বারবার, নিউ মার্কেট এক বার।’ এই বাজারের বিখ্যাত জুতোর বিপণিতে ঢোকার লাইন মেনরোডে এসে পৌঁছেছে। নিউ মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক দেবু ভট্টাচার্যও জানালেন, ভিড় নিয়ে কোনও আক্ষেপ নেই তাঁদের। মার্কেটের ভিতরের দোকানগুলি যদি বা একটু ফাঁকা, তা পুষিয়ে দিচ্ছে ফুটপাথ।
বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।