শ্রী সদানন্দ গৌড়া
মাননীয় রেলমন্ত্রী
রেল ভবন
নয়াদিল্লি
মহাশয়,
আপনি সপ্তাহ তিনেক আগে মন্ত্রকের দায়িত্ব নিয়ে রেলের উচ্চপদস্থ কর্তাদের ডেকে যে বার্তা দিয়েছিলেন, তাতে ট্রেনের অন্য নিত্যযাত্রীদের মতো আমরা, কলকাতার মেট্রো রেলের যাত্রীরাও কিছুটা ভরসা পেয়েছিলাম। আপনি বলে দিয়েছিলেন, ‘হয় কাজ করুন, নয়তো পথ দেখুন।’ যাত্রীদের স্বার্থে মানবিক হয়ে কাজ করার জন্য সর্বস্তরের রেলকর্মীদের কাছে বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন আপনি।
আপনার সেই কড়া মনোভাবের ফলে ভারতীয় রেলের অন্য ক্ষেত্রে কোথায় কতটা পরিবর্তন হয়েছে, তা জানি না, তবে সোমবার কলকাতার মেট্রো রেলে যা অভিজ্ঞতা হল, তাতে মনে হয় মাননীয় রেলমন্ত্রীর বার্তা রেল ভবনের বাইরে সাধারণ রেলকর্মীদের মধ্যে এখনও পৌঁছয়নি।
না হলে আপৎকালীন সব ব্যবস্থা যেখানে থাকার কথা, সেখানে তার পরেও সুড়ঙ্গের ভিতরে অন্ধকার কামরায় যাত্রীরা প্রায় দেড় ঘণ্টা আটকে থাকেন কী করে?
পার্ক স্ট্রিট স্টেশনের ১০০ মিটারের মধ্যে ট্রেনটি দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও উদ্ধারকারী দলের পৌঁছতে কেন এক ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে গেল? কী কারণে ট্রেন ওই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, সেই ব্যাপারে ঘোষণা করে যাত্রীদের আশ্বস্ত করতেই বা এক ঘণ্টা সময় লাগল কোন যুক্তিতে?
প্রায় দম বন্ধ হওয়া অবস্থায় আটকে থাকা যাত্রীদের অনেকে একটু হাওয়ার জন্য যখন ট্রেনের খোলা জানলার কাছে গিয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছিলেন, তখন মেট্রো রেলের ব্লোয়ারগুলি কী করছিল?
মন্ত্রী মহাশয়, আপনি হয়তো জানেন প্রতিটি স্টেশনেই একটি করে আপৎকালীন দল মজুত থাকে। যে কোনও সমস্যা হলে তাঁরা যাত্রীদের সহায়তায় ছুটে যান। সোমবার কিন্তু প্রথম এক ঘণ্টায় ওই বাহিনীর দেখা মেলেনি। যাত্রীদের তাই প্রশ্ন, সত্যিই কি প্রতিটি স্টেশনে মেট্রো রেলের আপৎকালীন বাহিনী রয়েছে? এক ঘণ্টা পরে যাঁরা এলেন, তাঁরাও সংখ্যায় নগণ্য। যাত্রীদের সাহায্য করার মতো কিছুই করতে দেখা যায়নি তাঁদের। বিভিন্ন স্টেশনে কামরায় হাওয়া ঢোকানোর যে সব ব্লোয়ার কেনা হয়েছিল, সেগুলি কী অবস্থায় রয়েছে, সে ব্যাপারে এক বার খোঁজ নিলে ভাল হয়। রেকের রক্ষণাবেক্ষণের দিকটিও যে পুরোপুরি অবহেলিত, সোমবারের ঘটনাই তার প্রমাণ।
এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। ট্রেনের সামনে মোটরম্যানের কেবিনের বাঁ দিকে, সুড়ঙ্গের মধ্যে ছিল বিশাল বৈদ্যুতিক বক্স। তার সামনে পেডেস্টাল ফ্যান ঘুরছিল। সেই রকম কয়েকটি ফ্যান কি টেনে এনে কামরার মধ্যে হাওয়া খেলানোর ব্যবস্থা করা যেত না? আসলে মেট্রো রেলের কর্তারা যাত্রীদের সুরক্ষার কথা আদৌ ভাবেন কি না, তা নিয়ে সোমবারের ঘটনার পরে যাত্রীদের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে।
বন্ধ ট্রেনে দেড় ঘণ্টা আটকে থাকায় জামাকাপড় যখন ভিজে সপসপে, সেই অবস্থায় মোটরম্যানের কেবিনের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসতে গিয়ে দেখলাম, ওই কেবিনের ফ্যান কিন্তু চলছে। মেট্রোর কয়েক জন কর্তা সেখানে দিব্যি দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছেন। তাঁরাই কেউ কেউ তড়িঘড়ি যাত্রীদের কার্যত ধাক্কা দিয়ে নীচে নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
আপনাকে জানাই, সুড়ঙ্গে আমাদের ‘অভ্যর্থনা’র জন্য অপেক্ষা করছিলেন আরপিএফ-এর জওয়ানেরা। এতক্ষণ আটকে থাকার পরে মুক্তি পাওয়ার আনন্দে অনেকে নিজেদের মোবাইলে সেই ছবি তুলে রাখতে চাইছিলেন। কিন্তু আরপিএফ জওয়ানদের কেউ কেউ ‘ছবি তোলার অপরাধে’ ওই সব যাত্রীদের প্রায় কলার ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। এমনকী, যাত্রীদের জেলে ভরে দেওয়ার হুমকিও দিলেন তাঁরা। সেই সময়ে সুড়ঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা কলকাতা পুলিশের জনা দু’য়েক অফিসার হস্তক্ষেপ না করলে সুড়ঙ্গের ভিতরে অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হতে পারত। সেই সময়ে মেট্রোকর্তাদের কাউকেই কিন্তু সেখানে দেখতে পাওয়া যায়নি। অথচ মোবাইলে যে ছবি তোলা যাবে না, মাইকে একবার সেটা ঘোষণা করলে কিন্তু সুড়ঙ্গে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হত না।
সুড়ঙ্গে প্রায়ান্ধকার ট্রেনে ঘণ্টা দেড়েক দাঁড়িয়ে থাকার পরে ১০০ মিটার হেঁটে যখন পার্ক স্ট্রিট স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে উঠলাম, তখন ভেবেছিলাম সেখানে দেখব, মেট্রোকর্তারা চিকিৎসক নিয়ে অপেক্ষা করছেন। অন্তত যাত্রীদের এক বোতল করে ঠান্ডা জল মেট্রো কর্তৃপক্ষ দেবেন, এমন আশাও করেছিলেন যাত্রীদের অনেকে। কিন্তু কোথায় কী? আমাদের সঙ্গে থাকা এক বৃদ্ধ অসুস্থ হয়ে রীতিমতো কাঁপছিলেন। তাঁকে ধরে বেঞ্চে বসিয়ে দিলেন সহযাত্রীরাই।
আপনি জানলে হয়তো অবাক হবেন, সুড়ঙ্গে দেড় ঘণ্টা আটকে থাকার পরে যাত্রীদের জন্য আরও দুর্ভোগ অপেক্ষা করছিল। এখন মেট্রোযাত্রীদের একটা বড় অংশ স্মার্ট কার্ড ব্যবহার করেন। কিন্তু দেখা গেল, সব ক’টি স্মার্ট গেট খোলা। অর্থাৎ, বেরোনোর সময়ে স্মার্ট কার্ড ‘পাঞ্চ’ করার দরকার নেই। কিন্তু ফের মেট্রোর প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে গেলে সেই স্মার্ট কার্ড আর তা হলে ‘পাঞ্চ’ করা যাবে না। ওই কার্ড ‘ব্লক’ হয়ে যাবে। স্মার্ট গেটের সামনে দাঁড়ানো কর্মীরা দেখিয়ে দিলেন কাউন্টারের সামনে দাঁড়ানো দীর্ঘ লাইনের দিকে। অর্থাৎ, ওখানেই স্মার্ট কার্ডের ‘ব্লক’ সরাতে হবে। পাতালে বন্দি থাকা যাত্রীরা তখন একটু বাতাসের খোঁজে বাইরে বেরিয়ে আসতে আকুল। এতক্ষণ আটকে থাকা যাত্রীদের এই হেনস্থাটাও কি প্রাপ্য ছিল? কী মনে হয় আপনার?
রেলের নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি স্টেশনে যাত্রীদের অভিযোগ জানানোর জন্য একটি কমপ্লেন্ট বুক বা অভিযোগের খাতা থাকে। কোনও ভাবে হেনস্থা হওয়া কিংবা সমস্যায় পড়া যাত্রীরা সেই কমপ্লেন্ট বুকে নিজেদের মন্তব্য লিখে যেতে পারেন। এই ব্যাপারে ঘোষণা করার কথা প্রতিটি স্টেশনে। কিন্তু সোমবার পার্ক স্ট্রিট স্টেশনে সেই ধরনের কোনও ঘোষণাই করা হয়নি। এই ভাবেই দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছেন মেট্রো রেল-কর্তৃপক্ষ।
মন্ত্রী মহোদয়, মেট্রো রেল এখন কলকাতাবাসীর কাছে অতি প্রয়োজনীয় একটি পরিষেবা। সময় বাঁচাতে, নির্ঝঞ্ঝাটে যাতায়াত করতে আমাদের মতো নিত্যযাত্রীরা মেট্রো ছাড়া অন্য কিছুর কথা ভাবতেই পারেন না। সোমবারের নিদারুণ অভিজ্ঞতার পরে মঙ্গলবারও মেট্রো চেপেই আমি অফিসে এসেছি। কিন্তু একটা সত্যি কথা বলব আপনাকে? এ দিন ময়দান থেকে পার্ক স্ট্রিটের পথটা পেরোনোর সময়ে বুকটা দুরুদুরু করছিল। আমার এক সহযাত্রী ব্যাগ থেকে একটি হাতপাখা বার করে বললেন, ‘‘আমার স্ত্রী দিয়ে দিয়েছেন। সোমবারের মতো ঘটনা হলে কাজে লাগবে।’’
এ দিন অফিসে এসেছি এসি রেকে। তাই ভয়টা ছিল বেশি। এসপ্ল্যানেড স্টেশনে পৌঁছে টেনটি দাঁড়িয়ে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু থেমে যাওয়ার কারণ নিয়ে এ বারও কোনও ঘোষণা নেই। না স্টেশনে, না ট্রেনে। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে, দরজা খোলা তবু অনেক যাত্রীকেই অধৈর্য হয়ে পড়তে দেখলাম। মিনিট তিনেক পরে ট্রেন ছাড়ল। চাঁদনিতে নেমে জিজ্ঞেস করে জানলাম, নির্ধারিত সময়ের আগেই এসপ্ল্যানেড স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছিল ট্রেনটি। সেই তথ্যটা যাত্রীদের দিতে যে কেন দেওয়া গেল না, তা বোধগম্য হল না।
মন্ত্রী মহাশয়, আশা করি কলকাতার মেট্রো রেলে পরিষেবার এই চিত্র আপনাকে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।
নমস্কার।
দেবদূত ঘোষঠাকুর
কলকাতা