গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
গাফিলতি রয়েছে আরজি কর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপালের। পুলিশি তদন্তেও রয়েছে একগুচ্ছ অনিয়ম। আরজি করের এক চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিতে গিয়ে মঙ্গলবার স্পষ্ট ভাষায় এ কথা জানিয়েছে কলকাতা হাই কোর্ট। সেই সঙ্গে প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ— আরজি কর-কাণ্ডে বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে রাজ্যকে র্যাফ মোতায়েন করতে হয়েছে। ফলে স্পষ্ট, বিষয়টি নিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।
মঙ্গলবার একসঙ্গে আরজি কর-কাণ্ডে দায়ের হওয়া পাঁচটি জনস্বার্থ মামলার শুনানি হয়। সেখানেই একাধিক বিষয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। রাজ্যের কাছে কেস ডায়েরি তলব করা হয়েছিল মঙ্গলবারের শুনানিতে। দুপুর ১টার মধ্যে সেই কেস ডায়েরি আদালতে জমা দিয়েছিল রাজ্য সরকার। সেই রিপোর্টকে সামনে রেখে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। এর পর সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়ে জানায়, এই মামলায় রাজ্যের হাতে থাকা সব তথ্য এবং নথি সিবিআইকে দিতে হবে।
শুধু তা-ই নয়, যে সব সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছিল পুলিশ, তা-ও সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিতে হবে বলে জানিয়েছে হাই কোর্ট। দুই বিচারপতির বেঞ্চ পর্যবেক্ষণের গোড়াতেই জানিয়েছে, ৯ অগস্ট টালা থানা অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের করেছিল। সাধারণত, কোনও অভিযোগ না এলে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে নির্যাতিতা চিকিৎসক ওই হাসপাতালেই কর্মরত। আশ্চর্যের বিষয়, তার পরেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং প্রিন্সিপাল কোনও অভিযোগ দায়ের করেননি। বেঞ্চের মন্তব্য, ‘‘আমাদের মতে, এটা তাদের গাফিলতি। এ থেকে সন্দেহ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক।’’
গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
আরজি কর-কাণ্ডে অন্য কেউ জড়িত থাকার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও গত ৯ অগস্ট থেকে রাজ্য পুলিশ শুধুমাত্র এক জনকে (ঘটনাচক্রে যিনি কলকাতা পুলিশেরই সিভিক ভলান্টিয়ার) গ্রেফতার করেছে। যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে হাই কোর্ট। পাশাপাশি, তদন্তকারী পুলিশ আধিকারিকেরা কেন হাসপাতালের প্রিন্সিপাল এবং সুপারের বয়ান নেননি, তা নিয়েও বিস্ময় প্রকাশ করেছে। সিবিআই তদন্তের নির্দেশের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বেঞ্চের মন্তব্য, ‘‘এটি একটি বিরল ঘটনা। অন্য মামলার ক্ষেত্রে আদালত রাজ্যের রিপোর্ট তলব করে। এ ক্ষেত্রে কোনও সময় নষ্ট না করে আদালত প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে বাধ্য হয়েছে।’’
প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার (৯ অগস্ট) সকালে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগের চার তলায় রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছিল মহিলা চিকিৎসকের দেহ। ঘটনাকে কেন্দ্র করে শোরগোল পড়ে গিয়েছে রাজ্যে। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ— পাঁচ দিন কেটে গেলেও তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ কোনও অগ্রগতি হয়নি বলে আদালত মনে করছে। তাই সময় অপচয় না করে পরিবার ও জনস্বার্থ মামলাকারীদের আবেদন আদালত গ্রহণ করেছে। প্রসঙ্গত, জনস্বার্থ মামলায় মূলত তিনটি আবেদন করা হয়েছিল হাই কোর্টে। তার মধ্যে প্রধান হল সিবিআই বা অন্য কোনও নিরপেক্ষ সংস্থাকে দিয়ে এই ঘটনার তদন্ত করানো। যে সংস্থার উপর রাজ্যের প্রভাব থাকবে না। এ ছাড়াও ওই ঘটনায় কে বা কারা জড়িত, অবিলম্বে তদন্ত করে তা প্রকাশ্যে আনার আবেদন জানিয়েছেন মামলাকারীরা।
জুনিয়র চিকিৎসকের দেহ উদ্ধারের পরে শুক্রবার প্রথমে খুন এবং ধর্ষণের অভিযোগ তুলে আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন আরজি করের জুনিয়র চিকিৎসকেরা। পরে সেই আন্দোলনে যোগ দেন অন্য চিকিৎসকেরা। সেই আন্দোলন শুধু আরজি করের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এই ঘটনায় দোষীদের কঠোর শাস্তির দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে রাজ্য, এমনকি দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকদের মধ্যেও। এই পরিস্থিতিতে আমজনতার অসন্তোষ এবং ভাবাবেগকেও গুরুত্ব দিয়েছে প্রধান বিচারপতি শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি ভট্টাচার্যের বেঞ্চ। বিচারপতিরা জানিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে বলা হয়েছে, বিরলতম ঘটনায় মানুষের আস্থা অর্জনের জন্য কোনও মামলা রাজ্যের হাত থেকে নিয়ে সিবিআই বা নিরপেক্ষ তদন্তকারী সংস্থাকে দেওয়া যেতে পারে। তাই রাজ্যের সংস্থা (পুলিশ) মানুষের আস্থা অর্জন করতে না পারায় সব দিক খতিয়ে দেখে স্বচ্ছ, সত্য ও সম্পূর্ণ তদন্তের জন্য সিবিআইকে দায়িত্ব দেওয়া হল।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে মঙ্গলবার শুনানি পর্বে নির্যাতিতার পরিবারের আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্যও ‘চাপ সৃষ্টির’ অভিযোগ এনেছেন। তিনি জানান, প্রথমে পরিবারের কাছে কেউ এক জন ফোন করে বলেন, আপনাদের মেয়ে অসুস্থ। তার পরে আবার ফোন করে বলা হয়, আপনাদের মেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। সেই প্রসঙ্গে আদালতে রাজ্য সরকার জানায়, পরিবারের দাবি সঠিক। দু’বার ফোন গিয়েছিল মৃতার পরিবারের কাছে। হাসপাতালের সহকারী সুপারই মৃতার পরিবারকে ফোন করেছিলেন বলে আদালতে জানায় রাজ্য। তবে ফোনে কী বলা হয়েছিল, তা নিয়ে আদালতে কিছু বলেনি রাজ্য।
মঙ্গলবার কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশের কিছু ক্ষণের মধ্যেই টালা থানায় পৌঁছে যান সিবিআইয়ের তদন্তকারী আধিকারিকেরা। সূত্রের খবর, সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্তের রিপোর্ট, সংগ্রহ করা এবং সিসিটিভি ফুটেজ পুলিশের হাত থেকে নেওয়ার জন্য তাঁরা গিয়েছিলেন। সিবিআইয়ের তরফে আরজি কর-কাণ্ডে এফআইআর-ও রুজু করা হয়েছে। কলকাতা হাই কোর্ট মঙ্গলবার স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, মামলার পরবর্তী শুনানিতেই সিবিআইকে তদন্তের অগ্রগতির রিপোর্ট জমা দিতে হবে। সে কারণেই সিবিআইয়ের এই তৎপরতা বলে মনে করা হচ্ছে।