প্রতীকী ছবি।
প্রায় দেড় বছর ধরে কার্যত ঘরবন্দি শৈশব।
স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি নেই। পাড়ার পার্কে বা মাঠে দাপাদাপি নেই। নেই বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটিও। তার বদলে মোবাইল আর টিভি-তে বন্দি জীবন। সেই আবহেই অতিমারির তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা যখন চোখ রাঙাচ্ছে, তখন ভাইরাসজনিত জ্বরে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাও বাড়ছে। আবার পুজোর ভিড়ে বেপরোয়া বড়দের দাপাদাপিতে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে শিশুদের নিয়েও। কারণ, বড়রা উপসর্গহীন কিংবা মৃদু
উপসর্গযুক্ত হলে তাঁদের থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে বাড়ির শিশুদের মধ্যেও।
দীর্ঘ দিন ঘরবন্দি থাকার কারণে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। আর তাই বিভিন্ন রোগে তাদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে— এমনটাই মনে করছেন শিশুরোগ চিকিৎসকেরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, প্রতি বছরই আবহাওয়া পরিবর্তনের মরসুমে শিশুদের জ্বর-সর্দি-কাশি হয়। কিন্তু এ বার সেই সংখ্যা কিছুটা বেশি এবং তার সঙ্গে শ্বাসকষ্টের প্রকোপ বৃদ্ধিও লক্ষ করা যাচ্ছে।
‘ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স’-এর জাতীয় স্তরের সহ-সভাপতি তথা চিকিৎসক অতনু ভদ্রের কথায়, ‘‘ভাইরাস প্রতি বছরই নিজের চরিত্র কিছুটা হলেও বদল করে। সেখানে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যদি কমে গিয়ে থাকে, তা হলে অতি সহজেই আক্রমণ করা সম্ভব হয়। শিশুরা তারই শিকার হচ্ছে। তাই আমরাও মনে করছি, স্কুল, খেলাধুলো চালু করা প্রয়োজন।’’ কিন্তু পুজোর ভিড়ের দাপটে আগামী দিনে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। অতনুবাবু আরও জানাচ্ছেন, করোনা পরিস্থিতিতে একটা সময়ে শিশুরা ঘরবন্দি থাকলেও বাবা-মাকে কাছে পেত। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁদের অধিকাংশই কর্মসূত্রে বাড়ির বাইরে যাচ্ছেন। ফলে অধিকাংশ শিশুরই একমাত্র ‘বন্ধু’ হয়ে উঠছে মোবাইল বা টিভি। আর তাতে তাদের শারীরিক বিকাশ ধাক্কা খাচ্ছে।
শিশুরোগ চিকিৎসকেরা বলছেন, “একা একা সময় কাটানোর ফলে শিশুর আবেগ-অনুভূতিতে অবসাদ তৈরি হচ্ছে। সেই কারণে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমছে। যা শিশুদের পক্ষে ক্ষতিকর।” তাঁরা আরও জানাচ্ছেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের সময়ে নাক দিয়ে জল পড়লে বা অল্প কাশি হলেও শিশুদের তেমন ভাবে ওষুধের প্রয়োজন পড়ে না। কারণ স্কুলে বা খেলার মাঠে গিয়ে এক শিশুর থেকে আর এক জন সংক্রমিত হলে তাতে গোষ্ঠী সংক্রমণ হয়ে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি হত। শিশুরোগ চিকিৎসক সুমন্ত ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘জন্মের সময়ে মায়ের থেকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পায় শিশু। তার পরে বাইরের পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শরীরে আরও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। কিন্তু এখন শিশুরা বাইরের পরিবেশ থেকে দূরে থাকায় সেই জায়গায় বড় ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। ফলে মিউটেশন হওয়া ভাইরাসে সহজেই আক্রান্ত হচ্ছে তারা।’’
‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজি’ (আইআইসিবি)-র ইমিউনোলজিস্ট দীপ্যমান গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘বিশেষত, শহরাঞ্চলের শিশুদের এমনিতেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় ঘাটতি থাকে। প্রয়োজনের থেকে তুলনায় বেশি পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকার ফলে ছোট থেকেই তাদের শরীরের পক্ষে বিভিন্ন জীবাণুকে চেনার সুযোগ কম। সূর্যের আলোয় বেশি ক্ষণ না থাকার ফলে দেহে ভিটামিন ডি-র ঘাটতি হচ্ছে।’’ তাঁর মতে, ঘরে বন্দি থেকে সেই সমস্ত ঘাটতি আরও বেশি মাত্রায় বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এমনকি, বন্ধু-আত্মীয়দের সঙ্গে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তা-ও শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে কাম্য নয়।
মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের মনোরোগ বিভাগের প্রধান চিকিৎসক রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ক্লাসরুমে ব্ল্যাক বোর্ডের পাশাপাশি অন্য বন্ধুদের থেকেও শিশুরা অনেক কিছু শেখে। কিন্তু করোনার ফলে দ্বিতীয় বিষয়টি মারাত্মক ধাক্কা খাচ্ছে। ক্লাসে শিশু তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছে না। উল্টে সে মোবাইল-ল্যাপটপকেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ায় মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় ঘাটতি হচ্ছে।’’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অনির্বাণ দলুইয়ের মতে, শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিতেই কম থাকে। করোনায় বন্দিদশার ফলে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ধাক্কা খাওয়ায় সেই ক্ষমতা আরও কমেছে। তাই বাইরে থেকে যখন কোনও সংক্রমণ নিয়ে বড়রা বাড়িতে ঢুকছেন, তাঁদের থেকে শিশুরা সংক্রমিত হচ্ছে ও রোগ গুরুতর আকার নিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘শিশুদের যে সমস্ত টিকা দেওয়া প্রয়োজন, তা সব দিতে হবে। যাতে অন্যদের থেকে তারা সংক্রমিত না হয়।’’
তবে পুজোর মরসুমে শিশুদের নিয়ে মা-বাবাদের একাংশের ভিড় ঠেলে প্রতিমা দর্শন অবিবেচনার পরিচয় বলেই আখ্যা দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। তাই সকলেরই সংশয়, আদৌ শিশুদের এই বন্দি-জীবন কাটবে তো!