অনুসন্ধান: স্টেট আর্কাইভসের সামনে ভিড়। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
নাম বলতে রাজি হননি মুর্শিদাবাদ-বীরভূমের দুই যুবক। শিকড়ের সন্ধানে কলকাতার কলেজপড়ুয়া কয়েক জন বন্ধু মিলে মঙ্গলবার দুপুরে স্টেট আর্কাইভস বা রাজ্য লেখ্যাগারের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। আবেদনপত্রে ১৯৬৬ সালের ভোটার তালিকায় বাবা-ঠাকুরদার নাম খুঁজছেন তাঁরা।
রাজাবাজারের সরকারি স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক সৈয়দ আফতাব আলমের অবশ্য রাখঢাক নেই। স্পষ্ট বলছেন, ‘‘বিজেপির রাজ্য সভাপতি তো বলেই দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি হবে। ২০২১-এ শুনছি ওরাই ক্ষমতায় আসবে। তাই ঝুঁকি নিতে চাই না।’’ আফতাবের ঠাকুরদার বাবা নালন্দা থেকে ১৯১৬ নাগাদ কলকাতায় এসেছিলেন। অসমের ধাঁচে এখানেও ১৯৭১-কেই নাগরিকত্ব প্রমাণের সময়সীমা ধরা হতে পারে ভেবে ১৯৬৬-র ভোটার-তালিকাই তাঁর অভীষ্ট। বর্ধমানের নাদনঘাটের ভোটার, পেশায় ফিজিয়োথেরাপিস্ট মহম্মদ ইয়াকুব শেখ বলছেন, ‘‘আমরা কালনার সাত পুরুষের বাসিন্দা। কিন্তু দেশের সরকারকে বিশ্বাস নেই। কে, কখন বাংলাদেশি বলে দেগে দেয়!’’ হাসনাবাদের ভোটার, কলকাতা বন্দরে কন্টেনার পরিষেবার কারবারি আব্দুর রেজ্জাক সর্দার নিজের ‘দূরদর্শিতা’য় মিটিমিটি হাসছেন। ‘‘এদের মতলবটা বুঝে এক মাস আগেই আমি আর্জি জানিয়েছি। একটু পরেই ভোটার তালিকার প্রমাণ হাতে পাব।’’
শেক্সপিয়র সরণির সরকারি দফতরের একতলায় ঢুকতেই শুকনো মুখে এমন অজস্র প্রত্যাশীর ভিড়। এত দিন মূলত অসমের বাঙালিরাই আসছিলেন। ‘এনআরসি-জুজুতে’ সন্ত্রস্ত পশ্চিমবঙ্গবাসীই এখন দলে ভারী। বিভাগীয় সহ-অধিকর্তা
সুবোধচন্দ্র দাস বললেন, ‘‘ভোটের আগে অমিত শাহ বাংলায় এনআরসি হবে বলার পরেই এ রাজ্যের মানুষও দলে দলে আসছেন। অসমের এনআরসি (নাগরিক পঞ্জি) প্রকাশের পরে ভিড়টা আরও বেড়েছে।’’ পুরনো ভোটার তালিকা এমন ‘মহার্ঘ’ হয়ে ওঠার পরে ১৯৭১ পর্যন্ত কয়েকটি জেলার ভোটার তালিকার ডিজিটাইজেশন হয়েছে। অসমের বাসিন্দা বাঙালিদের অনেকের পূর্বপুরুষ কোচবিহারের। এনআরসি-জটিলতায় কোচবিহারের
চাপটাই বেশি ছিল স্টেট আর্কাইভসে। এখন অন্য জায়গা থেকেও আগন্তুকের ছড়াছড়ি। এক আধিকারিক বললেন, ‘‘সোম-মঙ্গল দু’দিনেই ৬০ ও ৮০ জন এসেছেন। কর্মী কম। তাই সকলের আবেদনপত্র নিতে পারিনি।’’ তবে সরকারি কর্তারা সহৃদয়। পুরনো ভোটার তালিকার জাবদা খাতা খুলে আবেদনকারীদের খোঁজার অনুমতি দিয়েছেন। কাউকে কাউকে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে কম্পিউটারে। নাম খুঁজে পেলে তা জানাচ্ছেন তাঁরা। মাসখানেক পরে নথি মিলিয়ে টাইপ করা শংসাপত্র দিচ্ছে দফতর।
এনআরসি-র পরে অসমের ‘দেশহীন’ বাসিন্দারাও আসছেন। সেই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গবাসীর ভিড। কেউ জানেন না, এখানে এনআরসি হলে কবেকার নথি লাগবে। তবু যে যা পারেন, খড়কুটোর মতো নথি আঁকড়ে ধরছেন। বর্ধমানের মন্তেশ্বরের চাষি মোতু শেখ বোঝেনই না— ‘এনআরসি’ খায়, না মাথায় দেয়! ‘‘গেরামে বলল, দেশে থাকতে হলে বাবার নামের ভোটার লিস্ট চাই। তাই সেই নথির খোঁজে মুরুব্বির সঙ্গে কলকাতায় এসেছি,’’ বললেন মোতু।
নাগরিকত্বের অগ্নিপরীক্ষায় এখন এটুকু নথিই যে সম্বল!