প্রতীকী ছবি।
‘গ্রেড থ্রি লিস্ট ইজ় অলসো বিয়িং পাবলিশড শর্টলি।’ অর্থাৎ, ‘গ্রেড থ্রি তালিকা খুব শীঘ্রই প্রকাশিত হবে।’—শহরের হেরিটেজ তালিকার মুখবন্ধে এমনটাই ‘আশ্বাস’ দিয়েছিল কলকাতা পুরসভা। সময়টা ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারি। কিন্তু সেই ‘আশ্বাস’-এর প্রায় ১২ বছর পরে দেখা যাচ্ছে, ঐতিহ্য সংরক্ষণে ‘কেউ কথা রাখেনি।’ কারণ, পুর ওয়েবসাইট জানাচ্ছে, ‘গ্রেড থ্রি’ মর্যাদাপ্রাপ্ত বাড়ি ও ভবন-সহ সম্পূর্ণ হেরিটেজ তালিকা এখনও ‘পেন্ডিং’!
ফলে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলেও শহরের ঐতিহ্য রক্ষার ধারাবিবরণীর পরিবর্তন হয়নি বলেই মত ইতিহাসবিদ-হেরিটেজ স্থপতিদের একাংশের। তাঁদের বক্তব্য, সত্তরের দশক থেকে শহরের ঐতিহ্য রক্ষার ক্ষেত্রে যে ‘অবনমন’ শুরু হয়েছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। যেখানে শহরের ঐতিহ্য রক্ষার জন্য ‘নিরাপদ হাত’ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
কলকাতা-গবেষক হরিপদ ভৌমিক জানাচ্ছেন, শহরের ঐতিহ্য বর্তমানে শুধু কয়েকটি ‘হেরিটেজ টুর’-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে। কিন্তু ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য যে উদ্যোগ বা চেষ্টার প্রয়োজন, তার খামতি থেকে গিয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রশ্ন যখনই আসে, দলমত নির্বিশেষে তখনই প্রশাসনের তরফে দেখছি-দেখব বলে আশ্বাস দেওয়া হয়। অথচ কাজের কাজ কিছু হয় না। ঐতিহ্যশালী বাড়ি ক্রমেই প্রোমোটারদের দখলে চলে যাচ্ছে।’’
যদিও রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যান শুভাপ্রসন্ন বলছেন, ‘‘পুরসভার হেরিটেজ তালিকা পরিমার্জনের প্রয়োজন রয়েছে। তা নিয়ে পুর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথাও হয়েছে।’’ ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায় আবার মনে করেন, ‘‘দেশের অনেক শহরের তুলনায় এখনও কলকাতার ঐতিহ্যমণ্ডিত ভবনগুলি ভাল অবস্থায় রয়েছে। আমদাবাদে ঐতিহ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও ধর্মীয় বিভাজন করা হয়। এখানে কিন্তু সেটা করা হয় না।’’
কলকাতার ঐতিহ্য রক্ষার ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত ধর্মীয় বিভাজন স্থান পায়নি ঠিকই। কিন্তু, ঐতিহ্য রক্ষার কাজ যথাযথ হওয়া নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে! অথচ ঐতিহ্যের ইতিহাস বলছে, ১৯৯৭ সালের অক্টোবরে কলকাতা পুর এলাকায় হেরিটেজ বাড়ি, ভবন চিহ্নিত করার জন্য তৎকালীন রাজ্য সরকার বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করে। সেই বছরই আবার কলকাতা পুর আইনে শহরের ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য একটি নতুন অধ্যায় যুক্ত হয়। ১৯৯৮-এর নভেম্বরে সংশ্লিষ্ট কমিটি চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা করে।
কিন্তু অচিরেই বোঝা যায়, বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টটির পুনর্মূল্যায়ন ও পরিমার্জন প্রয়োজন। কারণ, বিশেষজ্ঞ কমিটি এমন অনেক বাড়ি, ভবনকে চিহ্নিত করেছিল, যেগুলির সেই অর্থে কোনও ঐতিহ্য-মর্যাদা নেই। ফলে ফের একটি সাব-কমিটি তৈরি করে হেরিটেজ মর্যাদার নিরিখে ও তার ভিত্তিতে সংরক্ষণের জন্য গ্রেড ওয়ান, গ্রেড টুএ, গ্রেড টুবি ও গ্রেড থ্রি মাপকাঠি ঠিক হয়।
কিন্তু ওই পর্যন্তই! হেরিটেজ-স্থপতি হিমাদ্রি গুহ বলছেন, ‘‘ঐতিহ্য সংরক্ষণের কাজ এমনিতেই শহরে দেরিতে শুরু হয়েছে। কিন্তু তার পরেও সেই কাজ যথাযথ ভাবে হচ্ছে না।’’ তৃণমূল সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায়ের বক্তব্য, ‘‘শুধু বাংলাই নয়, হেরিটেজ সংরক্ষণের কাজে আমরা ভারতীয় হিসেবেই পিছিয়ে রয়েছি।’’
সে কারণেই হয়তো ১২ বছর পরেও হেরিটেজ-তালিকা সম্পূর্ণ করা যায় না। আবার ২০১৯ সালের অগস্টে একটি মামলার রায়ে কলকাতা হাইকোর্ট মন্তব্য করে—‘২০১৫ সালের ২৭ জুলাই হেরিটেজ কনর্জ়াভেশন কমিটির সিদ্ধান্ত মননহীন (নন-অ্যাপ্লিকেশন অব মাইন্ড) ও সম্পূর্ণ যান্ত্রিক ভাবে (অ্যাবসলিউট মেকানিক্যাল ডিসিশন) নেওয়া সিদ্ধান্তের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যেখানে নথিও যথাযথ ভাবে যাচাই করা হয়নি।’
হাইকোর্টের এই মন্তব্যকে শহরের হেরিটেজ-রক্ষার বাস্তব চিত্র বলে মনে করছেন অনেকে। যেখানে নথি যাচাই ছাড়াই ‘মননহীন’ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে যায়। সেই ঐতিহ্য নিয়ে রাজনীতিকদের যতই দড়ি-টানাটানি চলুক না কেন!