আকর্ষণ: ভাইফোঁটায় নতুন নোবেল মিষ্টি। ছবি: প্রকাশ পাল
সাত রাজার ধন এক মানিক নয়! আবার সাত রাজার ধন এক মানিকই বটে! এই ভাইফোঁটায় আদরের ভাই বা বোনটিকে কোনও কোনও দাদা-দিদি এ বার নোবেলেই বরণ করলেন।
কলকাতার উপকণ্ঠে রিষড়ায় শতাব্দীপ্রাচীন ধ্রুপদী মিষ্টি স্রষ্টার শো-কেসে চোখে পড়ছে সেই হলুদবরণ অবয়ব। ইন্টারনেটে নোবেল পুরস্কারের মেডেলের ছবির খোঁজ লাগালে যেমনটি চোখে পড়ে। হলুদ সোনার মেডেলের এই পুরস্কারের নেপথ্য পুরুষ অ্যালফ্রেড নোবেলের মুখের ছাপটুকুর সঙ্গে বাঙালি ময়রার সৃষ্টি অবশ্য পুরোটা মেলেনি। তবু মিল একটা আছে বৈকি! পুজোর ঠিক পরেই হইচই ফেলে দেওয়া বাঙালির নোবেল-স্বীকৃতির অভিঘাতে মিষ্টির জগতের এই বিপণনই বঙ্গজীবনে নতুন উদ্যাপন।
নোবেল সন্দেশের রূপকার ফেলু ময়রার উত্তরপুরুষ অমিতাভ মোদক হাসছিলেন, ‘‘বেশ কয়েক বছর আগে বোলপুরে রবীন্দ্রনাথের স্মারক প্রদর্শনীতে এই নোবেল-ছাপ সন্দেশের আইডিয়াটা মাথায় আসে! বিশ্বকাপ উপলক্ষেও তো বছর-বছর কাপের আদলে সন্দেশ তৈরি হয়। নোবেলই হোক বা বিশ্বকাপ— সত্যি সত্যি না-চাখলে বাঙালির তৃপ্তি হবে না।’’
রবীন্দ্রনাথের নোবেল-স্বীকৃতি নিয়ে পুরন্দর ভাটের অমর স্তব অনেকেরই মুখস্থ! ‘সকলে কুড়ায় বেল,/ তুমি একা কুড়াও নোবেল,/ ইস্কুলে না পড়িয়া ফার্স্ট তুমি,/ বাকি ডাহা ফেল’। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেলজয়ের পরে কিছুটা সেই ভঙ্গিতেই সোশ্যাল মিডিয়ায় কলার তুলেছিল বাঙালি। মিষ্টির ফেলু ময়রা বলছে, ‘‘ভাইফোঁটায় আমাদের এ বারের টেক্কা ‘নোবেল’-ই!’’ বারবার নোবেল জয়ে বাঙালির কেরামতির পরে ভাইফোঁটার মতো খাঁটি বাঙালি আবেগের সঙ্গে নোবেলের রসায়ন খুঁজে পাওয়াটা অনেকেরই স্বাভাবিক ঠেকছে।
বিপণনের কসরত হিসেবে নোবেলের আবাহনেও বাংলার মিষ্টি-সংস্কৃতির একটা প্রাচীন পরম্পরা রয়েছে। সেই উনিশ শতক থেকেই সমকালের ইতিহাস-রাজনীতির আঁচে নিজেকে সেঁকে নিয়েছে বাংলার ভিয়েন। যেমন, একদা রানি ভিক্টোরিয়ার আমলে প্রথম বড়লাটের বৌ লেডি ক্যানিংয়ের কলকাতায় আগমন উপলক্ষে পান্তুয়াকে সামান্য বদলে লেডিকেনির উদ্ভব হয়। যে লেডিকেনি কালের প্রবাহে আজও উজ্জ্বল। রানি ভিক্টোরিয়ার রাজ্যাভিষেকের সময়ে দেখা মিলেছিল করোনেশন সন্দেশ বা এমপ্রেস গজার। আবার বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে কংগ্রেস সভাপতি হয়ে মতিলাল নেহরু কলকাতা এলে ভীম নাগ পেশ করেছিল পেস্তার নেহরু সন্দেশ। ভীম নাগেই আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিজড়িত আশুভোগ বা নবাব ওয়াজ়িদ আলি শাহের নামে নবাবখাস আত্মপ্রকাশ করে। সেন মহাশয়-এর দাবি, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসে দেলখোসে জাফরান, পেস্তা, সরের মিশেলে গড়ে ওঠে ‘জয় হিন্দ’।
একেবারে সাম্প্রতিক কালেরও নমুনা রয়েছে। সচিন তেন্ডুলকরের ১০০টি আন্তর্জাতিক শতরান উদ্যাপন করতে ‘শচীন’ সন্দেশ তৈরি করে সিমলেপাড়ার নকুড় নন্দী। গোলাকার সন্দেশের গর্ভে সরের নাড়ু, কাঠবাদামের
উপাদান। সৌরভ সন্দেশও একটা আছে বটে, যা কাছাকাছি সময়েই তৈরি হয়। ‘‘কিছু সন্দেশ বা মিষ্টি একটা তাৎক্ষণিক আবেদনের উপরেই চলে। সেই আবেদন ফিকে হলে, মিষ্টি নিয়েও তত আগ্রহ থাকে না।’’ তবু বছর-বছর ভোটপুজোয় রাজনৈতিক দলের প্রতীক সন্দেশ, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের রঙের সন্দেশও বাজারে আসে। ভবানীপুরের বলরাম মল্লিক
২০১৪-র ভোটের আগেই নরেন্দ্র মোদী, রাহুল গাঁধী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়দের নামে সন্দেশ তৈরি করে। মোদীর নামে সন্দেশে আবার চায়ের স্বাদ মিশেছিল।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল-প্রাপ্তির পরে নানা বিজ্ঞাপনেই উদ্যাপনের মেজাজ। আমূল মাখনের বিজ্ঞাপনও ‘আভি জিত গয়া’ বলে সেই আনন্দে গা ভাসিয়েছে। তবে মিষ্টির মাধ্যমে উদ্যাপনের কৌশল আলাদা। বিজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞ সৌভিক মিশ্রের কথায়, ‘‘মার্কেটিংয়ের কৌশল আর প্রডাক্ট-ডিজ়াইন অর্থাৎ মিষ্টির ধাঁচ, এ বার এক সন্দেশে মিশে গিয়েছে।’’ শেষমেশ নোবেল সন্দেশের জনপ্রিয়তা কত দিন টিকবে, তা অবশ্য স্বাদ ও মানের পরিচয়েই মালুম হবে।