বালি ব্রিজ— দিনে। শুক্রবার।
রাত সাড়ে দশটা। ডানলপ পেরিয়ে বালির দিকে আসার পথে থমকে যেতে হয়েছিল এক ছোট গাড়ির চালককে। দক্ষিণেশ্বর মোড় পার করে একটু উপরের দিকে উঠতে গিয়ে তিনি চমকে গিয়েছিলেন। বুঝতে পারছিলেন না আচমকা অন্ধকার জঙ্গলে চলে এলেন কী ভাবে। দু’পাশ থেকে রাস্তার উপরে নুইয়ে পড়েছে বড় গাছ। গাড়ির হেড লাইটেও স্পষ্ট হচ্ছিল না অন্ধকার। কিছুক্ষণ পরে ট্রেনের শব্দে ভুল ভাঙতেই তিনি বুঝতে পারলেন দক্ষিণেশ্বর থেকে বালি ব্রিজে উঠছেন!
শুধু ওই চালক নন, প্রতি দিনই সন্ধ্যা নামার পর থেকে বালি ব্রিজে এ হেন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে অনেককে। তবে শুধুমাত্র বালি ব্রিজে ওঠা কিংবা নামার রাস্তার এমন বেহাল অবস্থা নয়। গোটা সেতুর দু’দিকে আলো থাকলেও তার অধিকাংশই জ্বলে না বলেই অভিযোগ। ওই এলাকা দিয়ে যাওয়া পথচারী এবং গাড়িচালকদের আরও অভিযোগ, এই আলো-আঁধারির সুযোগে প্রতিনিয়ত বালি ব্রিজে বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কাজকর্ম হচ্ছে।
এই অভিযোগ যে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, গত বুধবারই তার প্রমাণ মিলেছে। দক্ষিণেশ্বর থেকে বালির দিকে আসার রাস্তার ফুটপাথ থেকে অচৈতন্য অবস্থায় এক গৃহবধূকে উদ্ধার করেন স্থানীয় যুবকেরা। ওই গৃহবধূর সঙ্গীকে আটক করার পরে পুলিশ জানতে পারে, রাত ৮টা থেকে সেতুর ফুটপাথের উপরে মোটরবাইক দাঁড় করিয়ে ওই গৃহবধূ ও তাঁর স্বামী-সহ সঙ্গীটি নেশা করছিলেন। আচমকাই স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি শুরু হয়। ব্রিজের রেলিংয়ে উঠে গঙ্গায় ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টাও করেন ওই গৃহবধূ। পরে স্বামীর সঙ্গে তাঁর হাতাহাতি হলে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। তবে শুধু ওই ঘটনাই নয়। মাঝেমধ্যেই রাতে বালি কিংবা বরাহনগর থানায় খবর যায়, বালি ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা থেকে পথচারী ও গাড়িচালকদের প্রত্যেকেরই অভিযোগ, স্রেফ যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ না করা এবং নজরদারির অভাবে প্রায় ৮৫ বছরের পুরনো এই সেতুর বেহাল অবস্থা। শুধু আলো না থাকা কিংবা জঙ্গলই নয়। গোটা বালি ব্রিজ জুড়েই রয়েছে বিবিধ সমস্যা। কোথাও রাস্তা জুড়ে বড় বড় গর্ত, কোথাও বা জমে থাকছে জল। কোথাও আবার সেতুর লোহা চুরি হয়ে যাচ্ছে।
বালি ব্রিজ— রাতে। শুক্রবার।
চারটি জেলার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছে এই বালি ব্রিজ। কিন্তু নানা সমস্যায় বেহাল দশা গুরুত্বপূর্ণ এই সেতুটির। সমস্যা কী কী?
বালি ব্রিজের মূল সমস্যা রয়েছে দক্ষিণেশ্বরমুখী রাস্তায়। দিনের পর দিন ওই রাস্তায় পিচ উঠে গর্ত তৈরি হলেও স্থায়ী মেরামতিতে কারও কোনও হুঁশ নেই। রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় পিচ উঠে তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। তা বাঁচিয়ে চলতে গিয়ে যানজট লেগে যাচ্ছে সেতুতে। রাজ্য পূর্ত দফতর সূত্রের খবর, ৮৮০ মিটার লম্বা ওই রাস্তার নীচে রয়েছে দশটি এক্সপ্যানশন জয়েন্ট। সেই জয়েন্টগুলির অবস্থা খুবই খারাপ। পূর্ত দফতরের উত্তর কলকাতা ডিভিশনের এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘ওই জয়েন্টগুলির নীচে থাকা ট্রাফ প্লেটগুলির খুবই খারাপ অবস্থা। গোটা ব্রিজটাই রয়েছে ওই প্লেটের উপরে। শেষ ৫০ বছরেও সেগুলি পাল্টানো হয়েছে বলে কোনও নথি আমাদের কাছে নেই।’’ পূর্ত দফতরের বাস্তুকারদের কথায়, দীর্ঘ দিন ট্রাফ প্লেট ও এক্সপ্যানশন জয়েন্ট রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি বলেই রাস্তা জুড়ে ‘মারণ ফাঁদ’ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়াও দু’দিকের রাস্তার গালিপিটগুলিও সব আবর্জনা পড়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে একটু বৃষ্টি হলেই সেতুর উপরে জল জমে যাচ্ছে।
পূর্ত দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, সেতুর কাঠামো মেরামতির দায়িত্ব পূর্ব রেলের। তাই ট্রাফ প্লেট সংস্কারের জন্য ইতিমধ্যেই ৪৬ লক্ষ টাকা রেলকে দিয়েছে রাজ্য পূর্ত দফতর। রেল ওই কাজ করার পরে পূর্ত দফতর ৬৪ লক্ষ টাকা খরচ করে এক্সপ্যানশন জয়েন্ট ও রাস্তা মেরামতি করবে। এই সমস্ত কাজের জন্য আগামী ডিসেম্বর থেকে প্রায় তিন মাস ব্রিজের বালি থেকে দক্ষিণেশ্বরমুখী রাস্তা বন্ধ রাখা হবে।
স্থানীয়দের আরও অভিযোগ, সেতুর দু’দিকের রাস্তায় আলো থাকলেও প্রতিদিন সব জ্বলে না। ফলে সন্ধ্যা নামলেই গোটা সেতু অন্ধকারে ভরে যায়। পথচারীদের আরও অভিযোগ, সেতুর দু’দিকের ফুটপাথের উপরে সার দিয়ে মোটরবাইক দাঁড় করিয়ে রাখেন যুবক-যুবতীরা। সেখানেই চলে বিভিন্ন নেশা। পথচারীদের আরও অভিযোগ, ফুটপাথের উপর দিয়েই অনেকে মোটরবাইক চালিয়ে নিয়ে যান, এর ফলে দুর্ঘটনা ঘটলেও তা দেখার কেউ থাকে না। পাশাপাশি, রাতের অন্ধকারে সেতুর রেলিং ও বিভিন্ন লোহার প্লেট চুরি হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়েরা আরও জানান, সেতুর দু’দিকে মোট চারটি পরিত্যক্ত ঘর (সেতু তৈরির পরে ওই ঘরগুলি থেকে টোল ট্যাক্স আদায় করা হত) রয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেখানে বিভিন্ন দুষ্কৃতীমূলক কাজকর্ম হয় বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। কয়েক বছর আগেই বালির দিকে এমন একটি ঘর থেকে কয়েক জন হাইওয়ে অপরাধে যুক্ত দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
স্থানীয়দের দাবি, রাজ্যে একমাত্র রেল ও সড়ক সেতু এই বালি ব্রিজ। সেখানে নিরাপত্তার জন্য সিসিটিভি এবং পুলিশি নিরপত্তার ব্যবস্থা করা দরকার। এমনকী, ওই চারটি ঘরকে সংস্কার করে কাফেটেরিয়া কিংবা পুলিশ আউট পোস্ট তৈরি করা যেতে পারে। রাজ্য পূর্ত দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘বিষয়টি নজরে এসেছে। বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে আলোর বিষয়ে কথা বলতে হবে। ঘরগুলি সংস্কার করা যায় কি না, তা-ও দেখা হবে।’’
নিরাপত্তার বিষয়ে কী বলছে পুলিশ?
ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার নীরজ সিংহ বলেন, ‘‘সেতু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পূর্ত দফতরকে অনেক বার জানানো হয়েছে। পুলিশও মাঝেমধ্যেই টহলদারি চালায়। তবে নিরাপত্তা নিয়ে কেউ নির্দিষ্ট অভিযোগ করেননি।’’ অন্য দিকে, হাওড়া সিটি পুলিশের এক পদস্থ কর্তাও সেতুতে টহলদারি হয় বলেই দায় সেরেছেন।
ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার ও নিজস্ব চিত্র।