খানাখাজানা: বিধি উড়িয়ে ভিড় পার্ক স্ট্রিটের একটি রেস্তরাঁয়। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
দ্বিতীয় ডোজ় হয়নি এখনও? দুঃখিত অষ্টমীর অঞ্জলি আপনার জন্য নয়। মণ্ডপমুখো না-হয়ে বরং রেস্তরাঁয় পানভোজনে চলুন।
রবিবার দুপুরে দেবীপক্ষের পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাতে রসিকতা করছিলেন স্থানীয় অফিসকর্মী জনৈক যুবক। কাচের জানলার ও-পাশে রেস্তরাঁর অন্দরে তখন তিলধারণের জায়গা নেই। পাশাপাশি টেবিলের ফাঁকে নামমাত্র পরিসর। বাইরেও ঢোকার লাইন। সে-দিকে তাকিয়ে গড়িয়ার দেবজ্যোতি কর বললেন, “আমার মা, বাবা অগস্টে কোভিড থেকে সেরে উঠেছেন। তাই প্রতিষেধকের দ্বিতীয় ডোজ়টা এখনও হয়নি। ফলে এ বার অঞ্জলি বন্ধ! কিন্তু এত লোক, জনে জনে রেস্তরাঁয় চেটেপুটে খাচ্ছে! সব্বার কী প্রতিষেধকের দুটো ডোজ় হয়েছে?” পার্ক স্ট্রিটে বার্বিকিউয়ের এক ম্যানেজার বলছেন, একেবারে অশক্ত বুড়োবুড়িরাও খেতে আসছেন! বাড়িবন্দি হয়ে ক্লান্ত! ওঁদের কি ফেরানো যায়?
সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠছে রেস্তরাঁর অন্দরে কোভিড-বিধি মেনে চলা নিয়ে। লকডাউনের গিঁট খুলে প্রথম রেস্তরাঁয় ঢুকে নিজেকে প্রায় মহাকাশচারী মনে হচ্ছিল। অনেকে অতিথিদের গায়ে কার্যত পিপিই কিটও চাপিয়ে দিচ্ছিলেন। আর এখন যা পরিস্থিতি, তাতে ভিতরে ঢোকার আগে গায়ে জ্বর আছে কি না, দেখারও কার্যত বালাই নেই। রেস্তরাঁর আপ্যায়নকারীরা সাধ্য মতো মাস্ক পরছেন। কিন্তু খাবার আসার ঢের আগেই অতিথিরা মাস্ক খুলে ফেলেছেন। পুজোর আগে রেস্তরাঁ কারবার আবার প্রাক্-করোনা পর্বের ৮০ শতাংশ ছুঁয়ে ফেলেছে বলে জানাচ্ছেন পূর্ব ভারতের হোটেল, রেস্তরাঁ সমিতির কর্তা সুদেশ পোদ্দার। উৎসবের সময়কার বাড়তি চাহিদা বুঝে রেস্তরাঁ, পানশালা পুজোয় রাত দশটার মধ্যে বন্ধ করতে হবে না বলে জানিয়েছে রাজ্য সরকার। তাতে দারুণ খুশি সুদেশের আশা, “ব্যবসা দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে!’’ কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের পরে অর্ধেক টেবিল ভর্তি করে রেস্তরাঁ খোলার অনুমতি পেয়েছিল রেস্তরাঁগুলি। এখন সে সব নিয়ম শিকেয়। কেন? এর সদুত্তর নেই সুদেশের কাছে।
মণ্ডপের ভিড়ে লাগাম পরাতে নানা চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু রেস্তরাঁগুলির উপরে নজরদারি চালানোর কোনও নোডাল অফিসার নেই রাজ্য সরকারের। খাতায়কলমে কোভিডের তৃতীয় ঢেউয়ের অস্তিত্ব এ দেশে স্বীকার করা হয়নি। তবে কোভিড যে বাড়ছে, এ বিষয়ে ডাক্তারদের ধন্দ নেই। এসএসকেএমের শল্য চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকার বলছেন, “দু’দিনের জ্বরে এখন অনেকেই কোভিড পরীক্ষা করাচ্ছেন না। অনেকের সংক্রমণ অল্পের উপর দিয়ে যাচ্ছে। তবে সংক্রমণ বাড়ছে।” তাঁর কথায়, “একটা বদ্ধ জায়গায় মাস্ক ছাড়া অনেকের বসে থাকাটা যে সুপারস্প্রেডার পরিস্থিতি তাতে সন্দেহ নেই।” বিলেতে লকডাউন তোলার শেষতম পর্যায়ে ছাড়পত্র পায় পানশালাগুলি। এখানে অবশ্য কোনও তাপ-উত্তাপ নেই।
পার্ক স্ট্রিটেই সর্বভারতীয় চেনের একটি বুফেয় খাবার নিতে গিয়ে এ দিন বার কয়েক হাঁচলেন এক মহিলা। যদিও সে দিকে কারও নজর গেল না। সকলেই তখন খাওয়া আর খাওয়ানোয় মশগুল। ডাক্তারবাবুরা বলছেন, বুফের ছোঁয়াছুঁয়ি থেকে সংক্রমণের আশঙ্কা তা-ও কম! কিন্তু মাস্ক ছাড়া বিপদ।
সাউথ সিটি মলের ফুডকোর্টে চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয় ঘিরে জনসমুদ্রে একটি রেস্তরাঁর কর্মচারী অজয় পারিদা, হাসান মণ্ডলেরা বলছিলেন, এসির মধ্যে হলেও আট-দশ ঘণ্টা টানা মাস্ক পরে থাকা খুব সোজা নয়। কয়েকটি রেস্তরাঁর কর্মীরা আবার মাস্কের উপরে ফেসশিল্ড চাপিয়েছেন। তাঁদেরই এক জন বলছেন, “ডাক্তার, নার্সদের নাগাড়ে পিপিই পরে থাকা নিয়ে অনেক কথা শুনেছি। কিন্তু আমাদের কষ্টটাও খুব কম নয়! কেউ একটু আধটু মাস্ক নামিয়ে রাখলে দোষ দিতেও পারছি না।” ভবানীপুরের এক পানশালার ম্যানেজার বললেন, “মালিক কোভিডের ভয়ে বাড়িবন্দি।” কিন্তু রেস্তরাঁ ভরপুর। জীবিকা গুরুত্বপূর্ণ,কিন্তু জীবন কি নয়? প্রশ্নটা তাই থেকেই যাচ্ছে।