পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সংসর্গের চিহ্ন মুছতে চাইছে নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘ। —ফাইল চিত্র।
যেন ইস্টবেঙ্গলের কোচ হয়েছেন ঘোর মোহনবাগানি সুব্রত ভট্টাচার্য। বা লাল-হলুদের চোখের তারা মনোরঞ্জন ওরফে ‘মনা’ সবুজ-মেরুন জার্সি ধারণ করেছেন। বিষয়টা এখন অনেকেরই তেমন মনে হচ্ছে। একদা কট্টর প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের নেতা অরূপ বিশ্বাসকেই আঁকড়ে ধরছে নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘ। অধুনা বন্দি, প্রাক্তন শিক্ষা ও শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সংসর্গের চিহ্ন মুছতে এ ছাড়া কার্যত নিরুপায় একদা ওজনদার পুজো।
গত দেড় দশকে কলকাতার পুজোর একেবারে সামনের সারিতে চলে আসা নাকতলা উদয়নের শ্রেষ্ঠ সময় পাড়ার ছেলে ‘পার্থদা’র মন্ত্রিত্ব পর্বেই। সেই সংস্রবই তাদের জন্য কাল হয়েছিল গত বছর। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত পুজোর উদ্বোধনে আসেননি। গত এক যুগে সেই প্রথম বার। অনেকেই মনে করেন, পার্থর ‘ছায়া এড়াতেই’ সরকারি বিশ্ব বাংলা বা পুরশ্রীর সুদীর্ঘ পুরস্কার তালিকাতেও ঠাঁই হয়নি নাকতলার। পাড়ার শরণার্থী ঘরের মায়েদের জীবন-জীবিকা, সেলাই কলের মোটা কাপড় বা খাদির সুতো নিয়ে শিল্পী প্রদীপ দাসের গত বছরের কাজ পুজো-রসিকদের নজর কেড়েছিল। তবু পুরস্কার তেমন জোটেনি। মুখ্যমন্ত্রীর সামনে রেড রোডের ভাসান কার্নিভালের জন্য বাছাই মর্যাদাও জোটেনি পুজোটির কপালে। বরং তখন ২০১৯-এ নাকতলার উদ্বোধনী মঞ্চে মমতা ও পুজোর ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর’ পার্থ-বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ভিডিয়োই নজর কাড়ছিল। তবে এই ২০২৩-এ ছবিটা পাল্টাচ্ছে। পুজোর সঙ্গে অরূপ বিশ্বাসের যোগসূত্রই সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
কিছু দিন আগে উদয়ন সঙ্ঘের রক্তদান শিবিরের অনুষ্ঠানে এলাকার বিধায়ক তথা মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস উপস্থিত ছিলেন। নাকতলা উদয়নের প্রতিদ্বন্দ্বী, কলকাতার আর এক মহাতারকা পুজো সুরুচি সঙ্ঘের প্রাণপুরুষ বলেই পরিচিত তিনি। স্থানীয় ১০০ নম্বর ওয়ার্ডের পুরপ্রতিনিধি প্রসেনজিৎ দাস ওরফে ডাবলি বললেন, ‘‘কোনও লুকোচুরি নেই যে, গত বছর আমরা সকলেই একটু দূরে-দূরে থেকেছি! কিন্তু এ বার আমায় অরূপদাই ডেকে বললেন— এগিয়ে আয়, হাল ধর। সবাই মিলে পুজোটা দেখ!” পুজোকর্তা অঞ্জন দাস ওরফে মিন্টু বলছেন, “ডাবলি (প্রসেনজিৎ দাস) পুজোর সভাপতি থাকলেও আমরা অরূপদাকে উপদেষ্টা রেখেই এগোব। অরূপদা তো পুজোটা কারও থেকে কম বোঝেন না! মাথার উপরে ওঁর হাত থাকাটাই বড় ভরসা।” মিন্টুর কথায়, “আমরা বাজেট নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু অরূপদা সটান বললেন— সব হয়ে যাবে। একটা পুজো এক দিনে বড় হয় না। আমার এলাকায় (টালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্র) এটাই সব থেকে বড় পুজো। এক ফোঁটা জমি ছাড়বি না!”
এই পুজোমণ্ডপ থেকে মিনিট পাঁচেক দূরের বাসিন্দা পার্থ চট্টোপাধ্যায় মন্ত্রী থাকাকালীন অবশ্য কোনও নেতাকেই এ পুজোর আশপাশে ঘেঁষতে হত না। নাকতলা উদয়নের সঙ্গে সুরুচি সঙ্ঘের অধিনায়ক অরূপের পা-টানাটানিই লেগে থাকত! উদয়নের এক কর্মকর্তার কথায়, "২০০৮-১০ নাগাদও অরূপদা পুজোর প্রস্তুতির সময়ে আমাদের মণ্ডপে ঢুকে পড়তেন। যা আমাদের ভাল লাগত না! অরূপদা তখনও টালিগঞ্জের বিধায়ক। না বলাটা একটু মুশকিল ছিল। কিন্তু পুজোর কাজ ওঁর (অরূপ) সামনে আমরা প্রাণপণে লুকিয়ে রাখতাম।”
২০২৩-এ পৌঁছে অবশ্য ঢের জল গড়িয়েছে গঙ্গা দিয়ে। সুরুচি এখনও অরূপেরই পুজো। তবু পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারের ফাঁকে তিনি বললেন, “গত পাঁচ বছর আমি কিন্তু সুরুচির কোনও নির্দিষ্ট পদে নেই। আমার এলাকার সব পুজোতেই আছি। আমি যেহেতু বিষয়টা বুঝি, সব পুজোকেই পরামর্শ দিই। আমার বিধানসভা এলাকার সব পুজোই আমার। নাকতলার সঙ্গেও অবশ্যই আছি!” আর কয়েক দিনের মধ্যেই থিমের কাজ শুরু হবে! তার প্রাক্কালে ‘পার্থর পুজো’কে ভরসা জোগাচ্ছে অরূপের এই আশ্বাস-বাণীই।