অনির্বাণ বসুধর, মীনাক্ষী বসুধর ও দীপক বসুধর
একটি ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হল একই পরিবারের তিন সদস্যের মৃতদেহ। শুক্রবার রাতে ঘটনাটি ঘটেছে বাগুইআটির জ্যাংরা এলাকার একটি আবাসনে।
মৃতদের নাম দীপক বসুধর (৬৫), মীনাক্ষী বসুধর (৫৭) ও অনির্বাণ বসুধর (৩৬)। পুলিশ জানায়, অনির্বাণবাবু মীনাক্ষীদেবী ও দীপকবাবুর একমাত্র ছেলে। মৃতদেহগুলির পাশ থেকে তিনটি সুইসাইড নোট উদ্ধার করেছে পুলিশ। সেখান থেকে জানা গিয়েছে, কিছু দিন আগে অনির্বাণের হাড়ের ক্যানসার ধরা পড়েছিল। সেই খবর পাওয়ার পর থেকে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে ওই পরিবার। পুলিশ জেনেছে, অনির্বাণ পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। দীপকবাবু একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ আধিকারিকের পদ থেকে অবসর নেন।
শুক্রবার রাতে বসুধর পরিবারের সদস্যদের মৃতদেহ উদ্ধারের পরে তাঁদের ফ্ল্যাট থেকে একটি মেডিক্যাল রিপোর্টও উদ্ধার করেছে পুলিশ। তদন্তকারীরা জানান, সেটি অনির্বাণের রিপোর্ট। গত ৬ জুলাই রিপোর্টটি তৈরি হয়। সেই রিপোর্টের কথাও তাঁদের সুইসাইড নোটে লেখা রয়েছে। এক তদন্তকারী অফিসার জানান, দীপকবাবু ও অনির্বাণের নোটে লেখা আছে, ক্যানসারের খবরেই হতাশ তাঁরা। তাই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। মীনাক্ষীদেবীর সুইসাইড নোটেও একই কথা রয়েছে। তবে এর পাশাপাশি মীনাক্ষীদেবীর নোটে লেখা আছে বাড়ির স্থাবর-অস্থাবর যা যা রয়েছে, তাঁদের মৃত্যুর পরে সেই সব জিনিসপত্র কাদের দেওয়া হবে। সুইসাইড নোট উদ্ধার করার পরে পুলিশের ধারণা, অনির্বাণের ক্যানসারের খবর জানার পর থেকেই দীপকবাবুরা আত্মহত্যার পরিকল্পনা শুরু করেন। বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের গোয়েন্দা প্রধান কঙ্করপ্রসাদ বারুই বলেন, ‘‘প্রাথমিক তদন্তে এটি বিষ খেয়ে আত্মহত্যার ঘটনা বলেই মনে করা হচ্ছে। ঘটনার তদন্ত চলছে।’’
গোটা ঘটনায় স্তম্ভিত বসুধর পরিবারের আত্মীয়েরা। কেন দীপকবাবু তাঁর ছেলের চিকিৎসার চেষ্টা করলেন না, কেনই বা অন্যান্য আত্মীয়দের সঙ্গে কোনও পরামর্শ করলেন না, সেই সব প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে বসুধরদের আত্মীয়দের মধ্যে। তাঁদের দাবি, দীপকবাবু, মীনাক্ষীদেবী কিংবা অনির্বাণ— তিন জনেই খুব চাপা স্বভাবের মানুষ ছিলেন। তাঁদের আত্মীয় শুভব্রত ঘোষ বলেন, ‘‘মাস খানেক আগে শুনেছিলাম অনির্বাণের শরীর খারাপ। কিন্তু ওর যে ক্যানসার ধরা পড়েছে, সে বিষয়টি ওঁরা আমাদের জানাননি। নিজেরাই মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে এত বড় ঘটনা ঘটিয়েছেন।’’
আত্মীয়েরা জানান, ২০ জুলাইয়ের পর থেকেই তাঁদের সঙ্গে বসুধর পরিবারের কোনও যোগাযোগ ছিল না। তাঁদের মোবাইল ফোনগুলিও বন্ধ ছিল। কোনও খবর না পেয়ে শুক্রবার তাঁরা জ্যাংরার ওই ফ্ল্যাটে যান। ফ্ল্যাটের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ ছিল। অনেক ডাকাডাকি করেও ভিতর থেকে কেউ সাড়া না দেওয়ায় ওই আত্মীয়েরা উল্টো দিকের একটি আবাসনের ছাদে ওঠেন। সেখান থেকে তাঁরা দেখেন, বসুধরদের ঘর অন্ধকার। তার পরে পুলিশে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ অনেক রাতে গিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে তিন জনের মৃতদেহ উদ্ধার করে।
তদন্তকারীরা জানান, ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখা যায়, ঘরে জিনিসপত্র সাজানো-গোছানো অবস্থাতেই রয়েছে। শোওয়ার ঘরে দীপকবাবু, অনির্বাণ এবং মীনাক্ষীদেবীর মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। মৃতদেহগুলিতে হাল্কা পচনও ধরেছিল বলে জানায় পুলিশ।
কাছের জনের অসুস্থতার খবরে ভেঙে পড়া নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু ক্যানসারের খবর পেয়ে এ ভাবে একসঙ্গে তিন জনের মৃত্যুতে স্তম্ভিত বসুধরদের পরিজন-প্রতিবেশী থেকে শহরের চিকিৎসক মহলও। ক্যানসার বিশেষজ্ঞ সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় ঘটনাটি শুনে বলেন, ‘‘ক্যানসারের চিকিৎসায় আমরা তো পঞ্চাশ বছর আগের যুগে পড়ে নেই। এখন অনেক আধুনিক চিকিৎসা এসেছে। বিশেষ করে হাড়ের ক্যানসারের ক্ষেত্রে বলতে পারি। বেশির ভাগ হাড়ের ক্যানসারই যথাযথ চিকিৎসায় সারিয়ে তোলা সম্ভব। ক্যানসার হয়েছে মানেই জীবনে দাঁড়ি পড়ে গেল, এমন মনে করার কোনও কারণই নেই।’’ আর এক ক্যানসার চিকিৎসক আশিস মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এই মানসিকতা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। বহু ক্যানসারই সময় মতো ধরা পড়লে এবং যথাযথ চিকিৎসা করা হলে, দীর্ঘদিন সুস্থ থাকা সম্ভব। ওই পরিবারকে হয়তো কেউ সঠিক দিশা দেখাতে পারেননি।’’