Muharram

‘দূরত্ব’ রেখেই সুরের রেশ মহরমের শোকবাসরে

বড় বেদনায় প্রাণে প্রাণে বেজে ওঠা মহরম মাসের সন্ধেগুলোয় সেই সুরের ছোঁয়াচ মেশে শহরে।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০২০ ০৩:৩৬
Share:

বিষাদ-গীতি: নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ ও বেগম হজরত মহলের পরিবারের ইমামবাড়ায় দূরত্ব-বিধি মেনে মহিলাদের মজলিস। পেমেন্টাল স্ট্রিটে। নিজস্ব চিত্র

মহরমের শোকসঙ্গীত মর্সিয়া মুখে মুখে বাঁধতেন ওয়াজিদ আলি শাহ। একযোগে দু’-তিনটি গান তৈরি করে এ শহরের মজলিসে মধ্যমণি হয়ে উঠতেন তিনি। রাশিদ খানের চোখে, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তানকারি ও আধ্যাত্মিকতা— দুই-ই মিশেছে মর্সিয়ায়। ‘‘ঠিক যেন কীর্তনের মতো। মর্সিয়া শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়।’’— বলছিলেন তিনি।

Advertisement

বড় বেদনায় প্রাণে প্রাণে বেজে ওঠা মহরম মাসের সন্ধেগুলোয় সেই সুরের ছোঁয়াচ মেশে শহরে। যেমন, পার্ক স্ট্রিট পাড়ার পেমেন্টাল স্ট্রিটে ওয়াজিদ আলি শাহ ও বেগম হজরত মহলের সন্তানদের বংশের খানদানি ইমামবাড়া। সন্ধ্যায় পুরুষের প্রবেশাধিকার নেই। বাড়ির বা মহল্লার জেনানাদের সঙ্গে বন্ধুজন বা অ-মুসলিম মেয়েরাও যোগ দেন শোকবাসরে। কারবালায় ইমাম হোসেনের হত্যার বিষাদ-গাথার ফাঁকে বুক চাপড়ে ‘মাতমে’র শোক-মূর্ছনায় জল আসে দু’চোখ ভরে। এ বার সেখানে বড়জোর পরিবারের পাঁচ-সাত জন বৌ-মেয়ের সমাবেশ।

তবে অনেক দূরে ঝাঁসি, ঢোলপুর বা নয়ডায় বসেও নজর রাখছেন বাড়ির মেয়েরা। রাফাত ফতেমা, তালাত ফতেমা, সালতানাত ফতেমার মতো প্রবাসী কলকাতা-কন্যেরা ইন্টারনেটে পাঠানো ভিডিয়ো লিঙ্কে চোখ রেখেই শোকপার্বণে বাপেরবাড়ির ছোঁয়াচটুকু পাচ্ছেন। কলকাতায় থেকেও আর এক বোন, বিরিয়ানি পটিয়সী মনজিলত বেগমের দশা তথৈবচ! ভাই কামরান আলি মির্জার খুদে পুত্তুর, ১২ বছরের সুলেমান ভার নিয়েছে ইমামবাড়া ‘স্যানিটাইজ’ করার। শোকের ‘মজলিস’ সরাসরি সম্প্রচারের খুঁটিনাটিও তার দায়িত্ব। কাল, রবিবার মহরমের আশুরা (১০ তারিখ) বা কারবালার যুদ্ধের রাত। দূরত্ব মেনে নাগাড়ে মজলিস চলছে। পেশায় তথ্যপ্রযুক্তি কর্তা কামরান শুক্রবার বলছিলেন, ‘‘ওয়াজিদ আলি শাহের পুত্র বির্জিস কাদর মেটিয়াবুরুজে খুন হওয়ার পরে এ পাড়ায় পালিয়ে আসেন তাঁর স্ত্রী, আমাদের দাদির শাশুড়ি মহতাব আরা বেগম। তখন তাঁর পেটে বাচ্চা। ১৮৯৩-এ লড়াকু সেই মহিলার হাতেই তৈরি আমাদের ইমামবাড়া।’’

Advertisement

এ শহরেই পার্ক সার্কাসের তালবাগানে ওয়াজিদ আলি শাহের পুত্র মির্জা মহম্মদ বাবরের বংশের আর একটি ধারা। তার বাহক, পেশায় শুল্ক আধিকারিক শাহেনশাহ মির্জার বাড়ির ইমামবাড়ায় এ বছর মজলিস বন্ধ। তাঁর কথায়, ‘‘শিয়াদের বেশ কয়েকটি ইমামবাড়ায় এ বার মজলিসে নামমাত্র ভিড়। কোভিড পরিস্থিতিতে সরকারি নির্দেশ বা স্বাস্থ্য-বিধি মেনে চলায় আপস করছি না। ফেসবুকে অনেকেই মজলিসের লাইভ স্ট্রিমিং করছেন।’’ কামরান সাহেবের ইউটিউব চ্যানেল বা ফেসবুক পেজেও কলকাতার বিভিন্ন মজলিসের ভিডিয়ো-ছবি।

ব্রেবোর্ন রোডে পর্তুগিজ গির্জার উল্টো দিকে হাজি কারবালা ইমামবাড়া বা বেনিয়াপুকুরে ১৮৩৩-এর বিবি আনারো ইমামবাড়া মজলিসে গুটিকয়েক লোক বেঁধে দিয়েছে। মেটিয়াবুরুজের শাহি ইমামবাড়া বা শুধু মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট কাফরুল বুকা ইমামবাড়াতেও ভিড় কম এ বছর। নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের জীবনকেন্দ্রিক ‘আখতারনামা’ উপন্যাসের প্রণেতা শামিম আহমেদ বলছিলেন, ‘‘লখনউয়ে ওয়াজিদ আলি শাহের পূর্বপুরুষ সুজাউদ্দৌলার সময় থেকেই মহিলাদের নিভৃতে মর্সিয়া গানের ধারাটি চলে আসছে।’’ রাশিদ খানের স্মৃতি জুড়ে উত্তরপ্রদেশের বদায়ুনে ঠাকুর্দার তালিমে মর্সিয়ায় গলা মেলানোর শৈশব। ‘‘তখন বুজুর্গরা বলতেন, মর্সিয়া গাইলে তানকারি ভাল হবে। সাবলীল তান আর উপরওয়ালার দিকে মন মিশেই তো শিল্প হয়।’’ রাশিদের কথায়, ‘‘কত রাগের সুন্দর প্রকাশ মর্সিয়ায়। আমার ছেলেকেও ওর মা শিখতে বলেন। আমাদের মিউজিক ক্লাবেও এই পরম্পরার সেবা করছি।’’

মেটিয়াবুরুজ বা ধর্মতলায় মহরমের তাজিয়া নিয়ে মিছিলে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের বহু স্মৃতি বহন করছে কলকাতা। অতিমারিতে শোভাযাত্রা নিষেধ। তবু মর্সিয়ার সুরটুকু সম্বল এই করোনা কালেও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement