প্রতীকী চিত্র
এ যেন হর্নের আওয়াজে ত্রস্ত এক শহরের ধারাবিবরণী! যেখানে অবাঞ্ছিত হর্ন বাজানোয় গত আড়াই বছরে আড়াই লক্ষেরও বেশি মামলা দায়ের হয়েছে পুলিশে। যার মধ্যে ২.৩ লক্ষ মামলাই রুজু হয়েছে ‘নো হর্ন জ়োন’ এলাকার নিরিখে। শব্দদূষণ সংক্রান্ত একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় পরিবেশ আদালতে এই তথ্য সম্বলিত এক হলফনামা জমা দিয়েছে কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশ। যা রীতিমতো বিস্ময়ের উদ্রেক করেছে পরিবেশবিদ মহল-সহ সমাজের অন্য স্তরেও।
কারণ পুলিশি সক্রিয়তার কারণে এই কেসগুলি নথিভুক্ত হলেও এই প্রশ্নও স্বাভাবিক ভাবে উঠছে, যদি সরকারি পরিসংখ্যানেই লাগামছাড়া হর্নের উৎপাত-সংখ্যা আড়াই লক্ষের বেশি হয়, তা হলে বাস্তবে সেই সংখ্যাটা আসলে কত? এক পরিবেশবিদের কথায়, ‘‘সমস্ত ঘটনাই যে পুলিশের নজরে এসেছে, সেটা বলা যাবে না। তা সম্ভবও নয়। কারণ, কেউ বিধি ভেঙে হর্ন বাজানোর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হল, সেটা তো হতে পারে না। এর জন্য নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে।’’
কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশের ‘অ্যাকশন টেকন রিপোর্ট’ অনুযায়ী, ২০১৯-এর জুন থেকে ২০২১-এর নভেম্বর— এই সময়সীমার মধ্যে লাগামছাড়া হর্নের ধারায় নথিভুক্ত মোট মামলার সংখ্যা (টোটাল হঙ্কিং কেসেস) প্রায় ২.৬ লক্ষ। এর মধ্যে ‘নো হর্ন’ জ়োনে হর্ন বাজানোর নিরিখে নথিভুক্ত হওয়া মোট মামলা ২,৩১,৯০২। লকডাউনের কারণে যান চলাচল বন্ধ থাকায় ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে শহর হর্ন-উপদ্রবের হাত থেকে তবু কিছুটা রেহাই পেয়েছিল।
পৃথক ভাবে জমা দেওয়া একটি রিপোর্টে আবার ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সেটি অনুযায়ী, ওই মাসে সাইলেন্স জ়োনে হর্ন বাজানোর জন্য দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা ৩৪২৫। এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট, শব্দদূষণ রুখতে পুলিশ কতটা সক্রিয়। নিয়ম ভেঙে লাগাতার হর্ন বাজানো কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।’’
প্রশাসন সূত্রের খবর, শব্দদূষণ রোধে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে রাজ্যের মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটির প্রথম বৈঠকে শব্দযন্ত্রে সাউন্ড লিমিটর (যে যন্ত্রের মাধ্যমে সাউন্ড সিস্টেম থেকে নির্গত শব্দের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়) বসানো, পরিবহণ, পুলিশ ও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের মধ্যে সমন্বয়, নির্দিষ্ট সময় অন্তর শব্দদূষণ রোধে কী পদক্ষেপ করেছে পুলিশ-প্রশাসন, সেই সংক্রান্ত ‘অ্যাকশন টেকন রিপোর্ট’ জমা করা-সহ একাধিক বিষয় উঠে এসেছিল। সেখানে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল যানবাহনের হর্নের দূষণ এবং তা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপের উপরে। প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘কেন্দ্রীয় মোটরযান আইন এবং রাজ্য মোটরযান আইন অনুযায়ী অবাঞ্ছিত, অপ্রয়োজনীয় হর্ন বাজানোর উপদ্রব রুখতে কী কী আইনি পদক্ষেপ করা যায়, তা সংশ্লিষ্ট সব দফতরকে জানানো হয়েছে।’’
যদিও তার যথাযথ বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয়ী পরিবেশবিদ মহলের একাংশ। সংশ্লিষ্ট মামলার আবেদনকারী, পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের কথায়, ‘‘হর্ন-দূষণের মাত্রা পরিমাপের জন্য যত সংখ্যক নয়েজ় মিটার থাকা দরকার ছিল পুলিশের কাছে, তা কি রয়েছে? তা থাকলে নথিভুক্ত মামলার সংখ্যা আরও বাড়ত।’’ তবে রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী রত্না দে নাগ বলছেন, ‘‘শুধুমাত্র আইন দিয়ে হর্নের উপদ্রব কমানো যাবে না। হর্নের শব্দ যে বিরক্তির সৃষ্টি করে, সেটা যিনি হর্ন দিচ্ছেন, তাঁকেও বুঝতে হবে।’’