শামিল: আর জি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে শনিবার রাতে পথে সব বয়সের মানুষ। সিঁথির মোড়ে। নিজস্ব চিত্র।
টানা খারাপ আবহাওয়া আর মাঝেমধ্যেই বৃষ্টি। সম্ভবত তার জেরেই এর আগে রাতদখলের কর্মসূচিগুলির মতো শনিবার রাতে শহর জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় তেমন ঢল নামেনি প্রতিবাদী জনতার। তবে আর জি করের নির্যাতিতার বিচারের দাবিতে গত শনিবারের রাতদখল কর্মসূচির তালও পুরোপুরি কাটেনি। কালীঘাটে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক ভেস্তে যেতেই পথে নেমেছেন অনেকে। বৃষ্টির মধ্যেই কেউ এসেছেন ছাতা নিয়ে, কেউ পরেছেন বর্ষাতি। কেউ আবার বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই স্লোগান দিয়েছেন ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। দমকা হাওয়া আর বৃষ্টিও নিভিয়ে ফেলতে পারেনি প্রতিবাদীদের হাতে থাকা জ্বলন্ত মোমবাতিগুলিকে।
ওই রাতে রাজপথ দখল নেওয়ার খানিক আগেও সকলের নজর ছিল টিভির পর্দায়। কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে দ্বিতীয় বৈঠকটিও ভেস্তে যেতে আন্দোলনকারীদের অনেকেই আর ঘরে বসে থাকতে পারেননি। রাত সাড়ে ৯টা বাজতে না বাজতেই দক্ষিণে যাদবপুর এইট বি বাসস্ট্যান্ড, গড়িয়া মোড়, গড়িয়াহাট মোড় থেকে শুরু করে উত্তরে শ্যামবাজার, সিঁথির মোড়ে আন্দোলনকারীরা জমায়েত করতে শুরু করেন। রাত যত বেড়েছে, ততই ভিড় বেড়েছে প্রতিবাদীদের।
রাত ১০টা নাগাদ যাদবপুর এইট বি বাসস্ট্যান্ডে ছাতা আর মোমবাতি হাতে নাগাড়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন কয়েক জন— ‘যতই বৃষ্টি উঠুক ঝড়, জাস্টিস ফর আর জি কর’। পাশ থেকে তখন স্লোগান উঠেছে, ‘শাসক তোমার কিসের ভয়, লাইভ স্ট্রিমিং কেন নয়’। দুর্যোগের মধ্যেই ভিজতে ভিজতে তত ক্ষণে গড়িয়া থেকে একটি দল মিছিল করে এসে পৌঁছেছে এইট বি বাসস্ট্যান্ডে। সুমন দাস নামে এক জন বলেন, ‘‘বিচার না পাওয়া পর্যন্ত ঝড়-বৃষ্টি কিছুরই পরোয়া করি না। আগেও প্রত্যেকটা রাতদখলে পথে ছিলাম। আগের রাতদখলে রাজপথে ছবি আঁকতে আঁকতে এসেছি। আজ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এলাম।’’ পাশে দাঁড়ানো মুনমুন চক্রবর্তী বলে ওঠেন, ‘‘আমাদের, অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে কেউ যেন বোকা না ভাবেন। প্রমাণ লোপাট করা হলে তা ধরা পড়বেই। কোনও সেটিং থাকলে তা ধরা পড়বেই। বিচার না পাওয়া পর্যন্ত রাত জাগা চলবে।’’ গড়িয়াহাট মোড়ে জমায়েত হওয়া কয়েক জন আবার জানান, কসবা থেকে হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা পৌঁছেছেন সেখানে। বৃষ্টির মধ্যেই মোমবাতি হাতে চলছে রাতদখল।
উত্তরে সিঁথির মোড়ে আবার স্লোগান দিতে দেখা গেল চার বছরের খুদে তমন্না বসুকে। মা-বাবার সঙ্গে এসেছে সে। ওই খুদের কথায়, ‘‘মায়ের সঙ্গে এসেছি। মা শিখিয়ে দিয়েছে, কী বলতে হবে।’’ তমন্নার মা জানান, এইটুকু শিশু সবটা বুঝছে না ঠিকই। কিন্তু এই বয়স থেকেই প্রতিবাদের ভাষাটা অল্প অল্প করে শেখা দরকার।
রাত বাড়তে থাকলে সিঁথির মোড়, শ্যামবাজারের মোড়ে আস্তে আস্তে ভিড় জমতে শুরু করে। সেখানে রাতদখলে আসা প্রতিবাদীরাও জ্বালিয়েছেন মোমবাতি। সিঁথি এলাকার বাসিন্দা মলয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘প্রতিটি রাত জাগাতেই আসছি। নৈতিক দায়বদ্ধতার মধ্যে জড়িয়ে গিয়েছি। বিচার না পাওয়া পর্যন্ত আসব।’’ তবে শনিবারের রাতের আন্দোলন অবশ্য অন্য রাতদখলের চেয়ে কিছুটা ফিকে ছিল। শ্যামবাজারে দু’-তিনটি প্রতিবাদী দল এসে কিছু ক্ষণ স্লোগান দিয়ে ফিরে যায়। তবে সিঁথির মোড়ে রাস্তা আটকে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ দেখান অনেক রাত পর্যন্ত। এই রাতের প্রতিবাদীদের স্লোগানে মিশেছে পুজোর কথাও। শ্যামবাজারে বিক্ষোভরত একটি দলের মুখে শোনা যায়, ‘বিচার না পেলে অভয়া, হবে না মহালয়া’। আবার সিঁথির মোড়ের স্লোগান ছিল— ‘এ বার ঢাকের তালে তালে, বিচার হবে তালে তালে।’
ঘড়িতে তখন রাত ১টা বেজে গিয়েছে। গড়িয়া থেকে স্কুটার চালিয়ে যাদবপুরের জমায়েতে এসেছিলেন মুনমুন মুখোপাধ্যায়। বললেন, ‘‘আমার মেয়েও বড় হচ্ছে। এক দিন সে-ও কর্মক্ষেত্রে যাবে। এই পরিস্থিতি থাকলে মেয়েকে বাইরে পাঠাতেই ভয় লাগবে। মেয়েদের রাতে কাজ কমিয়ে দেওয়াটা সমাধান হতে পারে না। আর জি করের নির্যাতিতার বিচার চাই।’’ পাশ থেকে শ্রেষ্ঠা সরকার বলেন, ‘‘মহালয়ার আগের রাতে এইট বি বাসস্ট্যান্ডে যে প্রতিবাদ জমায়েত করব, তার নাম দিয়েছি অভয়ালয়া। ওই রাতে ১১টা থেকে এইট বি বাসস্ট্যান্ডে রাতদখল হবে। ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া রেডিয়োয় চালানো হবে। সঙ্গে হবে শঙ্খধ্বনি।’’