নজরে: মাদুরদহের সেই বাড়ি। নিজস্ব চিত্র
প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাকতলার বাড়ি থেকে ইতিমধ্যেই ১২টি দলিল বাজেয়াপ্ত করেছে ইডি। যার মধ্যে একটি ‘সেন্ট্রি ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেড’-এর নামে। যে সংস্থার মালিক অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। অভিযোগ, কলকাতা পুরসভার ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডের ৬৮৩ নম্বর মাদুরদহের তেতলা বাড়িটিকে ওই সংস্থার মালিকানাধীন হিসেবে দেখানো হয়েছে এবং সেখানে চিকিৎসকদের ভাড়াটে হিসেবে রেখে একটি বেসরকারি হাসপাতালের কাছ থেকে প্রতি মাসে মোটা টাকা আদায় করা হচ্ছে।
ই এম বাইপাস লাগোয়া সেই আর এন টেগোর হাসপাতালের তরফে বলা হয়েছে, ‘‘আমাদের হাসপাতালে প্রায় তিন হাজার কর্মী কাজ করেন। যাঁদের মধ্যে চিকিৎসক, নার্সদের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মীরাও রয়েছেন। দূর-দূরান্তের ওই সমস্ত কর্মীর থাকার ব্যবস্থা করতে আমরা হাসপাতাল লাগোয়া কিছু ফ্ল্যাট লিজ়ে নিয়েছি। মাদুরদহের ওই তেতলা বাড়িতে চিকিৎসকদের থাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। তার জন্য ‘সেন্ট্রি ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে একটি সংস্থার সঙ্গে ২০১৩ সালে চুক্তি হয়। চিকিৎসকদের ফ্ল্যাটের ভাড়ার টাকা প্রতি মাসে সংস্থার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়। সেই টাকা থেকে টিডিএস-ও কাটা হয়।’’
মাদুরদহের ওই বাড়িটির প্রতিটি তলে দু’টি করে ফ্ল্যাট। দোতলা ও তেতলার দু’টি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা দুই চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা আর এন টেগোর হাসপাতালে কর্মরত। মাসের শেষে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই ভাড়ার টাকা পাঠিয়ে দেন তাঁরা।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, একটি বসতবাড়িকে বাণিজ্যিক সংস্থার ঠিকানা হিসেবে দেখিয়ে দীর্ঘ ন’বছর ধরে এই ব্যবসা চলছিল কী ভাবে? অনিয়মের এখানেই শেষ নয়। মাদুরদহের ওই বাড়িটি ‘সেন্ট্রি ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেড’-এর নামে দেখানো হলেও পুরসভার রেকর্ডে তার কোনও নথি নেই। এ দিকে, পুর লাইসেন্স বিভাগের রেকর্ডবলছে, মাদুরদহের ওই বাড়িটিকে ঠিকানা হিসেবে দেখিয়ে ২০১১ সালের ১০ ডিসেম্বর ‘সাগর গান্ধী এক্সপোর্টস প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে একটি সংস্থা পুরসভার ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছিল। যদিও সেই লাইসেন্সের মেয়াদ ২০১৩ সালের ২৩ মার্চ শেষ হয়ে যায়। পুর লাইসেন্স বিভাগের নথি বলছে, ওই সংস্থা চিংড়িরফতানি করত। ওই বাড়িটিকে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হলেও পুরসভার অ্যাসেসমেন্ট বিভাগের নথিতে এখনও সেটি ফাঁকা জমি হিসেবেই নথিভুক্ত রয়েছে। পুরসভার কর রাজস্ব বিভাগের রেকর্ড বলছে, ওই ফাঁকা জমির মালিক ছিলেন বেলেঘাটার বাসিন্দা, পেশায় চিকিৎসক সত্যরঞ্জন মজুমদার। যিনি ১৯৯৩ সালে মাদুরদহে ওই চার কাঠা ফাঁকা জমি কিনে ২০০৭ সালে সেটি পার্ক সার্কাসের এক বাসিন্দাকে বিক্রি করে দেন।
অর্পিতা যে সংস্থার নাম করে মাদুরদহের বাড়িটি হাসপাতালকে ভাড়া দিয়েছেন, সেই সংস্থার ওয়েবসাইটে লেখা রয়েছে, তারা লোহার যন্ত্রাংশ তৈরি করে। সেই ওয়েবসাইটে সংস্থার সদর দফতর হিসেবে ডায়মন্ড সিটির ফ্ল্যাটের ঠিকানা দেওয়া রয়েছে। যে ফ্ল্যাটে হানা দিয়ে ইডি প্রায় ২২ কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে।
মাদুরদহের ওই বাড়ির খুব কাছেই থাকেন প্রাক্তন আইপিএস নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘‘আমার বাড়িটি যে ঠিকাদার তৈরি করেছিলেন, তাঁর মাধ্যমেই ৬৮৩ নম্বর মাদুরদহের বাড়িটি পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও অর্পিতা মুখোপাধ্যায়কে বিক্রি করা হয়েছিল বলে শুনেছি।’’ ৬৮৩ নম্বর মাদুরদহ পুরসভার কর রাজস্ব বিভাগের খাতায় এখনও ফাঁকা জমি হিসেবে নথিভুক্ত থাকলেও দশ বছরেরও বেশি আগে সেখানে বাড়ি উঠে গিয়েছিল। এর পাশাপাশি, ১০৭ নম্বর ওয়ার্ডে কসবার রাজডাঙা মেন রোডের একটি প্রাসাদোপম অনুষ্ঠানবাড়ির একাংশও এখনও ফাঁকা জমি হিসেবে রয়েছে পুরসভার অ্যাসেসমেন্ট বিভাগের খাতায়। যার জেরে পুরসভা মোটা টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে কলকাতা পুরসভার কমিশনার বিনোদ কুমার বলেন, ‘‘সারা শহরে সমস্ত সম্পত্তির মূল্যায়নের কাজ দ্রুত শেষ করতে কর রাজস্ব বিভাগের আধিকারিকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’