ম্যাকনামারার সফর নিয়ে আনন্দবাজারের প্রতিবেদন।
যেন ইতিহাসের ‘পুনর্গঠন’! শহরের প্রবীণ নাগরিকদের কাছে যা বয়ে আনছে অর্ধশতক আগের ছবি। বিশ্ব ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান তথা আমেরিকার সদ্য প্রাক্তন প্রতিরক্ষা সচিব রবার্ট ম্যাকনামারাকে ‘অভ্যর্থনা’ জানাতে যে বার বিমানবন্দরের টারম্যাকে কলকাতা উজিয়ে নেমেছিল।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের ‘খলনায়ক’ ম্যাকনামারার সেই কলকাতা সফর ছাড়া মোদীর সফরের সঙ্গে তুলনীয় সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত খুঁজে পাচ্ছেন না ইতিহাসবিদ থেকে শহরের রাজনীতিকেরা। তবে ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায়ের মতে, ‘‘১৯২১ সালে গাঁধীর অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন প্রিন্স অব ওয়েলসের সফরের সময়ে শহরের মন খানিকটা এমনই হয়ে ছিল বলা চলে!’’
নিরাপত্তার দুশ্চিন্তায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রদবদল ঘটানো হয় বিশ্ব ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যানের কলকাতা সফরসূচিতে। প্রধানমন্ত্রী মোদীর কলকাতা সফরসূচিতেও এমন নানা বদল হয়েছে। হেলিকপ্টারে বা জলপথে ভ্রমণের নির্ঘণ্ট নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা রসিকতাও উপচে পড়েছে। প্রায় মোদীর রুটেই বিমানবন্দর থেকে হেলিকপ্টারে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে নেমে গাড়িতে রাজভবনে গিয়েছিলেন ম্যাকনামারা। সেটা ছিল ১৯৬৮ সালের ২১ নভেম্বর। যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়েছে রাজ্যে। সিপিএমের সে দিনের ছাত্রনেতা শ্যামল চক্রবর্তী বলছিলেন, ‘‘তখন বিমানবন্দরে এত কড়াকড়ি ছিল না। আমরা ডিওয়াইএফ এবং বিপিএসএফের (সিপিএমের ছাত্র সংগঠনের তখনকার নাম) ছেলেরা সটান টারম্যাকে প্লেনের কাছাকাছি কালো পতাকা হাতে চলে যাই।’’
আরও পড়ুন: ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথেই আটকে যাত্রীরা
তার আগের দিন আর এক তরুণ ছাত্রনেতা বিমান বসুকে ধরতে বাড়ি গিয়েও ব্যর্থ হয় পুলিশ। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বটানিক্যাল গার্ডেনে ম্যাকনামারা যাবেন বলে ঠিক হলেও পরে পরিকল্পনা বাতিল করেছিল প্রশাসন। পূর্ণিয়া থেকে বিশেষ বিমানে বিকেল তিনটে নাগাদ কলকাতায় নামেন সস্ত্রীক ম্যাকনামারা। তার ঘণ্টাখানেক আগেই বিমানবন্দর উত্তাল হয়ে উঠেছে। আনন্দবাজারের সে দিনের সংবাদ প্রতিবেদনের শিরোনামও বলছে, ‘ম্যাকনামারার কলকাতা আসা নিয়ে তিনটি ট্রাম পুড়ে ছাই’! দমদমে পুলিশের লাঠি, কাঁদানে গ্যাস ছাড়া কলেজ স্ট্রিটেও হাঙ্গামা ঘটে। শ্যামলবাবুর মনে আছে, বিমানবন্দরে তিনি এবং সুভাষ চক্রবর্তী গিয়েছিলেন। লাঠিতে কয়েক জন কমরেডের মাথা ফাটে। তবে শ্যামলবাবুর কথায়, ‘‘প্রধানত বিপিএসএফের দীনেশ মজুমদার প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠী বিমানবন্দরে যায়। নকশালপন্থীরা কলেজ স্ট্রিটে বিক্ষোভ দেখান।’’ সেই তুলনায় এ বার দলমত নির্বিশেষে পতাকাহীন তরুণ থেকে প্রবীণের কলকাতা ছেয়ে ফেলা অভূতপূর্ব বলে মনে করছেন কেউ কেউ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রাক্তন অধ্যাপক হরি বাসুদেবন বলছিলেন, ‘‘৪০ বছর কলকাতায় আছি। কারও বিরুদ্ধে প্রতিবাদে এমন জনজাগরণের ধাঁচে ঐকমত্য দেখিনি।’’
সে বার বিক্ষোভ ছড়ায় রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার, ধর্মতলা বা ডোরিনা ক্রসিংয়ের কাছে মার্কিন তথ্যকেন্দ্র ইউএসআইএসের তৎকালীন ঠিকানায়। কেউ কেউ বলেন, ম্যাকনামারা রাতে রাজভবন থেকে বেরিয়ে কলকাতা ঘুরেছিলেন। এ বারের প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে ধর্মতলা, গড়িয়াহাট, বিমানবন্দর ও পার্ক সার্কাসে।
পার্ক সার্কাসে প্রধানত মুসলিম মহিলাদের নেতৃত্বে অবস্থান বিক্ষোভের মতোই প্রিন্স অব ওয়েলসের সফরের আগেও এ শহরে মেয়েদের প্রতিবাদ মিছিল দেখা গিয়েছিল। রজতবাবু মনে করাচ্ছেন, ‘‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তীদেবীর নেতৃত্বে তখনকার হ্যারিসন রোডে কলকাতা পথে নেমেছিল।’’ অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে কৌশলগত ভাবেই বিলেতের রাজকুমারকে এ দেশে পাঠায় ব্রিটিশ সরকার। তবে তখন প্রতিবাদের ভাষা ছিল অন্য রকম। বিলেতের রাজকুমারকে বয়কটের ডাক দিয়ে তিনি আসার সময়ে কার্যত জনশূন্য হয়ে যায় ‘বম্বে’ এবং ইলাহাবাদ শহর। কলকাতাতেও বয়কটের ডাক দেওয়া হয়েছিল। তখনকার লাটসাহেবের বাড়ি থেকে গাড়িতে দক্ষিণ কলকাতায় যান প্রিন্স। রজতবাবু জানাচ্ছেন, সে বার এ শহরে প্রতিবাদ বেশি আগে শুরু হওয়ায় আসল দিনে তার রেশ কমে এসেছিল। তবে শহরে পুলিশ-সেনা মজুত ছিল।
রজতবাবু বলছেন, ‘‘প্রতিবাদের ভঙ্গি আলাদা হলেও জনতার ক্রোধের ধরনে ১৯২১-এর বিলেতের রাজকুমারের সেই সফরের সঙ্গেই তুলনীয় মোদীর কলকাতা সফর।’’