প্রতীকী ছবি।
বাবা-মা ঠিক করেছিলেন এখনই ছেলেকে মোবাইল দেবেন না।
বাবা বা মায়ের মোবাইল ফোন ব্যবহার করেই তাকে স্কুলের অনলাইন ক্লাস করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সেই অনলাইন ক্লাসের ফাঁক গলে গেম খেলা শুরু করেছিল ছেলে। ধরা পড়ায় বকুনিও দেওয়া হয়েছিল তাকে। এর পরে ২৪ ঘণ্টাও পেরোয়নি। বাড়ির একটি ঘর থেকেই উদ্ধার করা হয়েছিল আনন্দপুরের বাসিন্দা, অষ্টম শ্রেণির সেই পড়ুয়ার ঝুলন্ত দেহ।
গত কয়েক বছরে একাধিক এমন ঘটনা ঘটেছে শহরে।
সন্তানের অনলাইন গেমের নেশায় জেরবার অভিভাবকদের কেউ স্কুলের শিক্ষক, তো কেউ মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে ছুটেছেন। এই পরিস্থিতিতে কিছুটা স্বস্তি এনেছিল লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় চিনা ফৌজের আগ্রাসী আচরণের আবহে ভারত সরকারের অবস্থান।
সাইবার নিরাপত্তার যুক্তি দেখিয়ে ১১৭টি চিনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল কেন্দ্র।
টিকটক, উইচ্যাটের মতোই সেই তালিকায় ছিল পাবজি-র মতো গেমও। কিন্তু নাম বদলে ফের হাজির পাবজি। সূত্রের খবর, এ বার তার নাম হতে পারে ‘পাবজি মোবাইল ইন্ডিয়া’। ‘পাবজি কর্পোরেশন’-এর পেরেন্ট বডি ক্র্যাফ্টন ইঙ্গিত দিয়েছে, টেনসেন্ট গেমস-এর পরিবর্তে পাবজি মোবাইল ইন্ডিয়া-র পরিচালন ভার থাকবে মাইক্রোসফ্টের ক্লাউড কম্পিউটিং পরিষেবা সংস্থা ‘আজুরি’-র হাতে।
এই মুহূর্তে অনলাইন ক্লাসের কারণে এমনিতেই ছেলেমেয়েদের মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যবহারের সময় বেড়েছে। প্রশ্ন উঠছে, এর মধ্যে দেশের একাধিক হাইকোর্ট ঘোষিত ‘মোস্ট টক্সিক গেম’ পাবজি বা এই ধরনের অন্য গেম চালু হলে সেই ব্যবহারের সময় কি আরও বাড়বে না? মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম বলছেন, “এই সমস্যা এখন মারাত্মক। লকডাউনের পর থেকেই ছোটদের মোবাইলের অপব্যবহার নিয়ে সবচেয়ে বেশি অভিভাবক আসছেন আমাদের কাছে। অনলাইন ক্লাসের নামে ছেলেমেয়েরা মোবাইল নিয়ে কী করছে বা কেন এত মোবাইলে বুঁদ হয়ে থাকছে, তা বুঝেই উঠতে পারছেন না অভিভাবকেরা।” মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেবও বলছেন, “অভিভাবকদের অনেকেরই এই অভিযোগ থাকে। পাবজি কেন, সাবজি নামের কিছু এলেও একই সমস্যা হবে। এ ভাবে গেমের নেশায় বুঁদ করে একটা গোটা প্রজন্মকেই অন্য রকম বানিয়ে দিচ্ছে। সব থেকে বড় চিন্তা, ২০ বছরের যে ছেলেটি আজ গেমের উপরেই বাঁচছেন, ২০ বছর বাদে তিনি যখন পরিবার তৈরি করবেন তখন গেমে বুঁদ হয়ে থাকাটা তাঁর কাছে সমস্যার মনেই হবে না!”
ইন্ডিয়ান স্কুল অব এথিক্যাল হ্যাকিং-এর অধিকর্তা সন্দীপ সেনগুপ্তের দাবি, “গেমের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিকটা হল, যে খেলছে তার নিজের উপরেই নিয়ন্ত্রণ কমে যায়। এই ধরনের বেশির ভাগ গেমই যে হেতু মারামারি নির্ভর, তাই সহজেই প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তোলে। ব্যবহারকারী ভুলে যায় বাস্তব আর গেমের পার্থক্য। চটজলদি ফল পাওয়ার আশায় ভিতর থেকে সর্বক্ষণ অস্থির হয়ে থাকে। এই অস্থিরতাই বড় বড় অপরাধের জন্ম দেয়। নজরদারিতে কাজ হবে না। দ্রুত এ সব নিষিদ্ধ করা দরকার।”
মহাদেবী বিড়লা ওয়ার্ল্ড অ্যাকাডেমির প্রধান শিক্ষিকা অঞ্জনা সাহাও মনে করেন, “সরকারি ভাবে নিয়ন্ত্রণ ছাড়া অনলাইন গেম আটকানো কঠিন। তাই আমরা গেম থেকে জোর করে দূরে না সরিয়ে গেমের মাধ্যমে কিছু সৃষ্টির উপায় বাতলানোর চেষ্টা করছি। আগ্রহী পড়ুয়াদের দিয়ে বিভিন্ন গেম তৈরি করাচ্ছি। এতে ভাল সাড়াও মিলছে।’’
মডার্ন হাইস্কুলের অধিকর্তা দেবী করের মন্তব্য, “কোনও বিষয়ের আগ্রহ নেশায় পরিণত হওয়ার আগে তার যথার্থ ব্যবহারে সুন্দর সৃষ্টি করা সম্ভব। গেমের ক্ষেত্রেও তা-ই করতে হবে। এখানে অভিভাবকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্ক্রিনটাইম বাড়ল না কমল, সেটা কিন্তু বিষয় নয়। মোবাইলের স্ক্রিনটাইম যেন না হয় হিংসার গেম-টাইম, সেটা নিশ্চিত করা দরকার।”