এই অ্যাম্বুল্যান্স ঘিরেই অভিযোগ। বুধবার। নিজস্ব চিত্র
‘নিরাপদতম শহর’-এ মেয়েদের নিরাপত্তায় এত দিন রাতের আতঙ্ক ছিল ট্যাক্সি, অ্যাপ-ক্যাব বা প্রাইভেট গাড়ি। কিন্তু মঙ্গলবার রাতে ট্যাংরার ঘটনার পরে সেই আতঙ্কের তালিকায় যোগ হল আরও একটি যান— অ্যাম্বুল্যান্স! এর আগে গ্রাম বা শহরতলি থেকে শহরে রোগী আনতে বেশি ভাড়া চাওয়া, দালাল চক্রের সক্রিয়তা, না-চিকিৎসককেও চিকিৎসক হিসেবে অ্যাম্বুল্যান্সে বসানোর মতো একাধিক অভিযোগ উঠেছিল। তবে সে সব ছাপিয়ে ট্যাংরার ঘটনা প্রশ্ন তুলে দিল, এ শহরে মহিলারা অ্যাম্বুল্যান্সের মতো আপৎকালীন যান থেকেই বা কতটা সুরক্ষিত?
প্রশাসন সূত্রের খবর, সরকারি এবং বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা এ শহরে সমান্তরাল ভাবে রয়েছে। তবে দু’ক্ষেত্রে নিয়ম পালনে কিছুটা ফারাক থাকে। স্বাস্থ্য দফতরের নিজস্ব অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা রয়েছে। পাশাপাশি, সরকারি ও পুর হাসপাতালগুলিও তাদের অ্যাম্বুল্যান্স রাখে। সে সব চালাতে হাসপাতালগুলি স্বেচ্ছাসেবী বা কোনও অভিজ্ঞ সংস্থাকে চুক্তির ভিত্তিতে দায়িত্ব দেয়। অ্যাম্বুল্যান্সের চালক বা তাঁর সহকারীর যোগ্যতা সম্পর্কে তাতে যেমন উল্লেখ আছে, তেমনই অ্যাম্বুল্যান্স চালাতে কী কী নথি লাগবে তা-ও সেখানে রয়েছে। অ্যাম্বুল্যান্স চালক ও তাঁর সহকারীর ব্যবহার কেমন হবে, সে জন্য ১৩ দফা নিয়ম আছে। এ-ও বলা হয়েছে, চালকদের বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্সের পাশাপাশি ‘মোটর ভেহিকল্স’ দফতর থেকে ‘ক্লিন ড্রাইভিং রেকর্ড’-এর প্রমাণপত্রও জমা দিতে হবে। অ্যাম্বুল্যান্সের রেজিস্ট্রেশন, সেটি রাস্তায় চলাচলের উপযুক্ত কি না, তার শংসাপত্র, করের রসিদ, বিমার শংসাপত্র ও পরিবেশ ছাড়পত্র নথি হিসেবে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক।
এ তো গেল সরকারি ক্ষেত্রের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবার নিয়মকানুন। বেসরকারি ক্ষেত্রের কী অবস্থা?
অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবায় যুক্ত একাধিক সংস্থা জানাচ্ছে, এখানেই রয়েছে গলদ। সেটা কী? যেমন, শুধু পরিবহণ দফতরের রেজিস্ট্রেশন শংসাপত্র এবং সেটি অ্যাম্বুল্যান্স কি না, তা প্রমাণ করতে পারলেই যে কেউ ওই আপৎকালীন যান রাস্তায় নামাতে পারেন। ‘ভারতীয় রেড ক্রস সোসাইটি’-র পশ্চিমবঙ্গ শাখার সম্পাদক সৈয়দ নাসিরুদ্দিন জানাচ্ছেন, এখন তো বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতালেরই নিজস্ব অ্যাম্বুল্যান্স রয়েছে। পাশাপাশি, বিধায়ক বা সাংসদ তহবিলের টাকা পেয়ে অনেক ক্লাবও অ্যাম্বুল্যান্স চালিয়ে থাকে। বেসরকারি ক্ষেত্রে শুধু দেখতে হয়, পরিবহণ দফতরের রেজিস্ট্রেশনের শংসাপত্র এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স। তবে নামী বেসরকারি হাসপাতালের তরফে সব তথ্যই
রাখা হয়।
ট্যাংরার ঘটনা প্রসঙ্গে সৈয়দবাবুর বক্তব্য, ‘‘মঙ্গলবারের রাতে যে ঘটনা ঘটেছে তা খুবই উদ্বেগের এবং বিরল। এর আগে মহিলা-নিরাপত্তায়
কোনও অ্যাম্বুল্যান্স ঝুঁকির কারণ হয়েছে, এমন ঘটনা মনে করতে পারছি না!’’ শহরের বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবায় যুক্ত আর এক সংস্থার কর্ণধার বলেন, ‘‘কিছু দরকার নেই। যে সংস্থার অ্যাম্বুল্যান্স কিনবেন, টাকা দিলে তারাই সবটা করে দেবে।’’ এই ঘটনা থেকে সতর্ক হলেও একে বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখা উচিত, বলছে
অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবায় যুক্ত বেশির ভাগ বেসরকারি সংস্থা। তেমনই এক সংস্থার কর্তার মতে, ‘‘ঘটনাটি উদ্বেগের ঠিকই। কিন্তু একটি ঘটনা দিয়ে এই আপৎকালীন
পরিষেবা সামগ্রিক ভাবে বিচার করা উচিত হবে না।’’
বছর দুয়েক আগের ঘটনা। বীরভূমের বাসিন্দা অভিজিৎ দাস (১৬) নামে এক মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীকে বর্ধমান থেকে কলকাতায় আনার পথে অ্যাম্বুল্যান্সেই তার মৃত্যু হয়। পরে জানা যায়, ওই ‘ক্রিটিক্যাল কেয়ার’ অ্যাম্বুল্যান্সে চিকিৎসক
হিসেবে যে ছিল, সে আসলে এসি যন্ত্রের মিস্ত্রি! ২০১৮ সালের মার্চের ওই ঘটনার পরে ‘রাজ্য ক্লিনিকাল এস্টাব্লিশমেন্ট রেগুলেটরি কমিশন’-এর অধীনে অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবাকে আনতে নতুন আইন প্রণয়নের কথা ভাবা হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবাও আইনের আওতায় আসত। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, সে প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা সম্পূর্ণ হয়নি।
মঙ্গলবারের ঘটনায় অভিযুক্ত চালক এবং সহকারীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তবু প্রশ্নটা রয়েই গেল, মহিলাদের নিরাপত্তায় রাতের যান-আতঙ্কে কি এ বার অ্যাম্বুল্যান্সও যুক্ত হল? বিচ্ছিন্ন ঘটনা, তবু কি
নতুন সংযোজন?