দৃশ্য এক) রাস্তার ছোট্ট গর্তে জমে আছে প্রথম বৃষ্টির জল। আরামে সেই জলে স্নান সেরে নিচ্ছে চড়ুই।
দৃশ্য দুই) রেনি ডে’র হঠাত্ ছুটি। জানলা দিয়ে বাইরে ইলেকট্রিকের তারে সারি দিয়ে বসা ফিঙের দিকে তাকিয়ে আছে বছর দশের ছোট্ট তিয়াস।
কয়েক বছর আগে পর্যন্তও দৃশ্যগুলো ছিল ভীষণই পরিচিত। এখন নাগরিক-আকাশে নানা রকমের পাখির দেখা মেলা দুষ্কর। মানুষের বসতি যত বাড়ছে ততই কমে আসছে পাখিদের আবাসস্থল। শীতকালে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসা পরিযায়ী পাখিদের ঝাঁকেও ভাটার টান। সাধারণত নভেম্বর মাসে সাইবেরিয়া থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে আসে প্রায় ৮৫টিরও বেশি প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। এরা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কলকাতা সমেত পশ্চিমবঙ্গের পাখিরালয়গুলিতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু গত কয়েক বছরে তাদের সংখ্যা কমেছে। জলাভূমির সংরক্ষণে গাফিলতি, পাখিশিকারীদের দৌরাত্ম্য, পাখিদের প্রাকৃতিক বাসস্থান হ্রাস— সব মিলিয়ে অবলুপ্তির পথে ১৫৪টি প্রজাতির পাখি। বার্ড লাইফ ইন্টারন্যাশানাল এবং বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’র যৌথ সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছিল এমনই তথ্য।
পাখিদের সংখ্যা দ্রুতহারে কমার জন্য পরিবেশকর্মীরা দায়ী করছেন উন্নয়নের জন্য পরিবেশের উপর মানুষের লাগামছাড়া শোষণকে। প্রাকৃতিক বাসস্থানের অভাবে পরিযায়ী পাখিদের আসা-যাওয়ার উপরেও এর প্রভাব পড়েছে।
পক্ষীপ্রেমী পর্যটকদের কাছে সিঙ্গাপুরের জুরং বার্ড পার্ককে স্বর্গ বলা যেতেই পারে। ১৯৭১-এ তৈরি এই পার্কটি বর্তমানে পাখিদের সংখ্যার বিচারে পৃথিবীতে প্রথম। চারশোটি প্রজাতির প্রায় পাঁচ হাজার পাখি নিয়ে তৈরি এই পার্কে ২৯টি প্রজাতিই বিপদের মুখে। ৫০ একর জমির উপর নির্মিত বিশ্বমানের এই বার্ড পার্কটিতে পক্ষীপ্রেমীদের জন্য রয়েছে নানা আকর্ষণীয় সব প্যাকেজ। পাখিদের সঙ্গে দুপুরের খাবার, ছবি তোলা, আলাদা ভাবে সময় কাটানো— সবেরই বন্দোবস্ত রয়েছে।
সুখবর এ রাজ্যের পক্ষীপ্রেমীদের জন্যও। আগামী বছরের শেষের দিকে রাজারহাটের নিউটাউনেও দেখা মিলবে ম্যাকাও হর্নবিল, পেলিক্যানের মতো আরও হাজার পাখির। গত বছর অগস্টে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সিঙ্গাপুর ভ্রমণের সময় জুরং বার্ড পার্কে যান। প্রতিশ্রুতি দেন কলকাতার রাজারহাটে এমনই এক পাখিরালয় তৈরির। রাজারহাটের এই ‘পাখিবিতান’-এ সারা বছর ধরে বিভিন্ন পাখির দেখা তো মিলবেই, শীতকালে পরিযায়ী পাখিদের অন্যতম আশ্রয় হয়ে উঠবে এই পাখিরালয়।
পর্যটক টানতে কলকাতার বুকে এ রকম প্রয়াস নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয়। যদিও পরিবেশকর্মীদের একাংশের চিন্তা, এই যে দীর্ঘ দিন ধরে চলা উন্নয়নের রেশ তাতে পাখিদের কাছে এই অঞ্চল আর কতটা গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন আছে। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলেন, ‘‘পাখিরালয় করব বললেই তো হয় না। পাখিরা তাদের থাকার জায়গার বিষয়ে খুব ‘পার্টিকুলার’।’’ রাজারহাটের নিচু জলাভূমি বুজিয়ে যাবতীয় উন্নয়ন ঘটানো হচ্ছে বলে তাঁর অভিযোগ। সুভাষবাবুর বক্তব্য, ‘‘রাজারহাটের প্রকল্প যখন প্রথম শুরু হয় তখন যে পরিমাণ গাছ কাটা হয় তাতে পাখিদের আমরা উদ্বাস্তু করে ছেড়েছি। এখন ক়ৃত্রিম ভাবে গাছ লাগিয়ে পাখিরালয় তৈরি সহজ না।’’ তাঁর কথায় উঠে আসে রাজারহাটের আগেকার অবস্থা। সাপ, বেজি, বিভিন্ন প্রজাতির পাখির নিরাপদ আশ্রয় ছিল এই অঞ্চল। ‘‘পাখিদের কোনও পাসপোর্ট-ভিসা লাগে না। এক দেশ থেকে অন্য দেশে নির্দ্বিধায় চলে যায়। কিন্তু আমরা ওদের বসতি উপড়ে নিয়ে নিজেদের অট্টলিকা বানাচ্ছি।’’ মন্তব্য সুভাষবাবুর।