বইমেলায় হুয়ান পাবলো ভিয়ালোবোস। নিজস্ব চিত্র
এই প্রথম ভারতে এসেছেন। তবু অনেক কিছুই জীবন দিয়ে চেনা তাঁর। সোমবার বইমেলার মাঠে স্প্যানিশ বিশ্বের নানা টানাপড়েনের গল্প বলছিলেন বার্সেলোনাবাসী মেক্সিকান সাহিত্যিক হুয়ান পাবলো ভিয়ালোবোস। তাঁর কথা পরোক্ষ ভাবে যেন আজকের ভারতের সমাজ-রাজনীতির বাস্তবতাই মেলে ধরল।
মধ্য চল্লিশের হুয়ানের জন্ম মেক্সিকোর গুয়াদালাহারায়। স্পেনের বার্সেলোনায় উচ্চশিক্ষা। স্ত্রী ব্রাজ়িলীয়, কিছু দিন ব্রাজ়িলেও থেকেছেন হুয়ান। তাঁদের সন্তানদের জন্ম আবার বার্সেলোনায়। বার্সেলোনার পাঁচমিশেলি আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি চিনেছেন হুয়ান। আবার মেক্সিকো সীমান্তে এল সালভাদর, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাসের দেশহারা অভিবাসী শিশুদের গল্পও তিনি তুলে এনেছেন। স্প্যানিশ ছাড়া বই লিখেছেন পর্তুগিজ়েও। স্পষ্ট ইংরেজিতে হুয়ান বলছিলেন, ‘‘আমাদের বাড়িতে স্প্যানিশ, পর্তুগিজ়, ইংরেজি সবই চলে। একদা একটা স্পষ্ট সত্তার খোঁজে (আইডেন্টিটি) বিস্তর টানাপড়েনে ভুগেছি। এখন আর নির্দিষ্ট সত্তা নিয়ে পরোয়াই করি না।’’
এ সব কথার সূত্র ধরে অনিবার্য ভাবেই সমসময়ের ভারতের গল্পটাও উঠে আসে। সোমবার বইমেলার লাতিন আমেরিকার প্যাভিলিয়নে আলাপচারিতা শেষে হুয়ান বলছিলেন, ভারতীয় রাজনীতির খুঁটিনাটিও তিনি যথেষ্ট খেয়াল রাখেন। এ দেশে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন থেকে নানা জটিলতার উৎসও যে বিশুদ্ধ ‘আইডেন্টিটি’ নিয়ে টানাপড়েন, এই সার বুঝেছেন হুয়ান। তাঁর কথায়, ‘‘আমার মনে হয়, ভারত এক ধরনের আধ্যাত্মিক (স্পিরিচুয়াল) ফ্যাসিবাদের মুখোমুখি হচ্ছে। খাঁটি ভারতীয়ত্বের সংজ্ঞা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। এটা ভয়ঙ্কর!’’ দুনিয়া জুড়ে সমকালীন রাজনীতির নির্যাস যে এই ভয়ঙ্কর সঙ্কটই, স্পেনের ক্যাটালোনিয়ায় থেকেও সেটা বোঝেন হুয়ান।
হুয়ানের চার-পাঁচটি উপন্যাস এবং গল্পের সঙ্কলন অন্তত ১৫টি ভাষায় অনুদিত। সাহিত্যে নিজস্ব স্বরের খোঁজেও নানা নিরীক্ষার চাপান-উতোর ঠেলেই এগিয়েছেন। লাতিন আমেরিকার দেশহারা বাচ্চাদের নিয়ে লেখা বই ‘দি আদার সাইড’ (ইংরেজি সংস্করণ) যেমন সাহিত্য এবং সাংবাদিকতাকেও কার্যত মিলিয়ে দিয়েছিল। ‘‘বাচ্চাদের নাম-পরিচয় আমায় আড়াল করতে হয়েইছে। কিন্তু তাদের সংলাপগুলো প্রায় হুবহু বাস্তব।’’— বলছিলেন হুয়ান। বাস্তবের আলেখ্যকেই সাহিত্যের আখ্যানের আঙ্গিকে তিনি লিখেছেন।
তাঁর বই অনুবাদের সূত্রেই দেশ-কালের সীমানা ভাঙা সংস্কৃতি-সেতুর শরিক স্প্যানিশ বিশ্বের এই তরুণ প্রতিভা। বলছিলেন, ‘‘অন্য ভাষা ছেড়ে দিন, স্পেনের বাসিন্দাদের স্প্যানিশ নিয়েই মেক্সিকো বা আর্জেন্টিনার লোকেরা যা বিরক্ত হয়! লাতিন আমেরিকার স্প্যানিশে বিশেষণ বা গালমন্দ করার অভিব্যক্তিগুলোও আলাদা।’’ নিছকই শব্দনির্ভর নয়, অনুবাদ আসলে সংস্কৃতিগত বলেই হুয়ান মানেন। তাঁর বিশ্বাস, বই থেকে সিনেমার মতো ভাষান্তরও অনেক ক্ষেত্রেই একটা নতুন বইয়ের জন্ম দেয়। একটি উপন্যাসের ইংরেজি সংস্করণ বেরোনোর পরে মূল সংস্করণটিতেও কিছু রদবদল করেন হুয়ান। তাঁর মতে, ‘‘অনুবাদে অনেক কিছু হারাতে পারে, আবার নতুন কিছুরও স্বাদ মেলে, যা মোটেও মন্দ নয়!’’ দিনের শেষে ভাষার কুটুম্বিতার হয়েই সওয়াল করলেন বইমেলার অতিথি।