আমার কাছে মা দুর্গা অনাবিল আনন্দের একটি মুখ। কত মুখের ভিড়ে এক-একটি মুখ যেন মনে গেঁথে যায়। তা কি মায়ের মুখ, নাকি আশ্রয়ের মুখ, নাকি আনন্দের মুখ, নাকি মূর্তির মুখ? আমি বোধহয় প্যান্ডেল হপিং করতে করতে এই মুখগুলোই খুঁজে বেড়াই। ছেলেবেলা থেকে পুজোর সময়ে বাবার সঙ্গে ভাইবোনেদের নিয়ে রাতে গাড়ি করে ঠাকুর দেখা এক দারুণ অভিজ্ঞতা ছিল। বাবা শ্যামল ঘোষাল ছিলেন চলচ্চিত্রের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। প্যান্ডেলে সকলেই সমাদরে আমাদের ডেকে নিয়ে যেতেন। সেটা ছিল আমার কাছে মজার। বেশি ভিড় ঠেলতে হত না। আমরা ফাঁকায় ফাঁকায় ঘুরতে পারতাম। তাই ঠাকুর দেখার সংখ্যাটা গুণতিতে বেড়ে যেত। ছোটবেলার সেই আনন্দটা আবার এই ‘শারদ অর্ঘ্য’তে এসে ঠাকুর দেখা এবং বিচার করতে গিয়ে ফিরে পেলাম।
আগেও আনন্দবাজারের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে গিয়েছি বিচারক হিসেবে। এ যেন পরিবারের কাছে বছরে এক বার ফিরে আসা। এ বার আমরা তিন জন উত্তর কলকাতার ঠাকুর দেখলাম। সঙ্গে আমার অত্যন্ত প্রিয় শিল্পী সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় ও সহ অভিনেতা অরিন্দম শীল।
প্রথমে গেলাম আহিরীটোলা সর্বজনীন দুর্গোৎসবে। মনে হল ঢুকে পড়লাম কোনও শিল্পীর স্টুডিওতে। স্টুডিওর বাইরে নানা ধরনের ক্যানভাস, তাতে বিভিন্ন রকমের ছবি আঁকা। ভিতরে ঢুকে দেখলাম, কুমোরটুলিতে মূর্তিতে সদ্য মাটি লেপা হয়েছে এমন কিছু অসমাপ্ত মূর্তিও রয়েছে। এক জন শিল্পীর স্টুডিওতে যা যা থাকতে পারে, ছড়িয়ে রয়েছে তেমন জিনিস। মাঝে দেবী। শিল্পীর স্টুডিওই তাঁর মন্দির। মন্দিরের মাঝখানে অবস্থিত দেবী দুর্গাই তার শক্তির উৎস, আস্থার উৎস, আরাধনার উৎস। চমৎকার লাগল!
আমাদের কাজটা খুব শক্ত। ছোটবেলার সঙ্গে এটাই তফাত। আগে ঠাকুর দেখা, গল্প করা আর হা হা করে হাসার মধ্যে কোনও কাজ থাকত না। শুধুই আনন্দ থাকত। এ বার উত্তর কলকাতায় আনন্দবাজারের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে গিয়ে কাজটা তাই কঠিন হল। কারণ যে পুজোগুলো শর্ট লিস্টেড হয়েছে, তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠকে বেছে নেওয়ার জন্য নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে।
দেখলাম পাতিপুকুর বসাক বাগান, বেলেঘাটা ৩৩ পল্লিবাসীবৃন্দ, দমদম তরুণ দল। এর মধ্যে আমার অসম্ভব ভাল লাগল দমদম তরুণ দলের পুজো। এ বার তাদের থিম ‘মায়ের আশ্রয়’। মহামায়ার মধ্যে আমার-তোমার মায়ের যে পরিচিত ছবি, যেমন সন্তানের ঘরে ফেরার জন্য অপেক্ষা, কিংবা প্রবল গরমে ঘেমেনেয়ে গোকুল পিঠে রান্না— সবই যেন টাটকা এই তরুণ দলের পুজোয়। মজার কথা, এখানে যিনি শিল্পী তাঁরও পরিচয় দেওয়া হয়েছে তাঁর মায়ের নাম ধরে। ধরা যাক তাঁর মায়ের নাম যদি পুতুল হয়, তা হলে নাম দেওয়া হয়েছে পুতুলের ব্যাটা অনির্বাণ। জয় সরকার সেখানকার আবহ সঙ্গীত করেছেন। তাঁর পরিচয় দেওয়া হয়েছে কল্যাণীর পোলা জয়। সারা প্যান্ডেলে মায়ের ব্যবহার করা ঘটিবাটি-বাসন, পরিচিত জিনিসপত্র। উৎসবের রঙে মাখা প্যান্ডেলের মধ্যে দিয়ে গিয়ে পৌঁছোলাম সেই মায়ের কাছে, যে মায়ের আর এক নাম আশ্রয়।
পরের গন্তব্য কাশী বোস লেন। বেশ কিছু বছর ধরে কলকাতার শ্রেষ্ঠ পুজো দেখছি। অনেক পুজো দেখেই ভাল লাগে। কিন্তু অনেক সময়েই মনে হয়, গত বছরের কোনও প্যান্ডেলে হয়তো এ রকম কিছু দেখেছি। কাশী বোস লেনে মনে হল, এটা সম্পূর্ণ আলাদা একটা ভাবনা। ওরা দেবী দুর্গার কাছে মুক্তি প্রার্থনা করেছে। যান্ত্রিক পৃথিবীর এই বন্দিদশা থেকে কাশী বোস লেনের দুর্গা মুক্তির অঙ্গীকারে বদ্ধ। যান্ত্রিক জীবনের শেকল থেকে, দূষণের দুঃস্বপ্ন থেকে পৃথিবী শস্য শ্যামলায় ফিরতে উৎসুক।
প্যান্ডেলে ঢোকার সময়ে রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ল। মনে পড়ল, রক্তকরবীর যক্ষপুরীর কথা। নন্দিনীর কথা। সেও তো মুক্তিই চেয়েছিল এই যান্ত্রিক যক্ষপুরী থেকে। মনে হল নন্দিনী কোথাও দুর্গার সঙ্গে মিশে আছে।