তখনও হাসপাতালে ভর্তি অপূর্ববাবু। নিজস্ব চিত্র
অপেক্ষা আর শেষ হচ্ছে না!
বছর দুয়েক আগে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ছেলের। সত্তরোর্ধ্ব বাবা তা মেনে নিতে পারেননি। ডান চোখ অন্ধ। প্রতিবেশীরা জানাচ্ছেন, তা সত্ত্বেও ছেলের পথ চেয়ে জানলার সামনেই বসে থাকতেন উল্টোডাঙার করবাগান এলাকার বাসিন্দা অপূর্ব বন্দ্যোপাধ্যায়। কেউ প্রশ্ন করলে বলতেন, ‘‘ছেলে আসছে। ফোন করেছিল। তাই বসে রয়েছি।’’
বৃদ্ধের সেই অপেক্ষা বন্ধ ছিল এক সপ্তাহ। গত শুক্রবার পুলিশ গিয়ে ওই জানলার সামনে থেকে সরায় অপূর্ববাবুকে। বসে থাকতে থাকতে কোনও ভাবে তাঁর পায়ে আঘাত লেগে ক্ষত তৈরি হয়ে যায়। তাতেই পচন ধরেছিল। পুলিশ জানায়, গন্ধে অতিষ্ঠ প্রতিবেশীরাই উল্টোডাঙা থানায় খবর দিয়েছিলেন। পুলিশ অপূর্ববাবুকে আর জি কর হাসপাতালে ভর্তি করায়। গত সোমবার সেখানেই তাঁর পায়ে অস্ত্রোপচার হয়েছে। বাদ গিয়েছে ডান পায়ের একটি আঙুল। বৃদ্ধ হাসপাতালে থাকাকালীন ওই জানলার সামনে বসে স্বামীর অপেক্ষায় ছিলেন অপূর্ববাবুর স্ত্রী, ষাটোর্ধ্বা অমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লোক দেখলেই তিনি জানতে চেয়েছেন, ‘‘ওর বাবার অপারেশন হল? কখন ছাড়বে হাসপাতাল থেকে?’’
গত বৃহস্পতিবার দোলের দিন হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন অপূর্ববাবু। ফের শুরু হয়েছে ছেলের জন্য অপেক্ষা। অস্ত্রোপচার হওয়া পা নিয়েই তিনি বসে থাকছেন জানলার সামনে। মাঝে মধ্যে জোর করে বিছানায় শুইয়ে দিচ্ছেন মেয়ে-জামাই।
করবাগানের জওহরলাল দত্ত লেনে তিনতলা বাড়ি রয়েছে প্রাক্তন আয়করকর্মী অপূর্ববাবুর। স্ত্রী এবং ছেলেকে নিয়ে একতলার ঘরে থাকতেন তিনি। বাকি ঘরগুলি ভাড়া দেওয়া। মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সেই স্বাভাবিক জীবন হঠাৎই ছন্দহীন হয়ে যায় ছেলে অনির্বাণের অকাল মৃত্যুতে। বাড়ির এক ভাড়াটে জানালেন, ওই ঘটনার পরেই অমিতাদেবী মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। তাঁর শরীরের বাঁ দিক এখন পক্ষাঘাতগ্রস্ত। ভাড়ার টাকায় সংসার চলে। মেয়ে সকাল-বিকেল দেখে যান। অপূর্ববাবুও ছেলের মৃত্যুর পর থেকেই অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে শুরু করেন। দিনভর বসে থাকতেন জানলার সামনে। এক ভাড়াটে বলেন, ‘‘ওখানে বসেই কোনও ভাবে চোট পেয়েছিলেন। সম্ভবত তা থেকেই গ্যাংগ্রিন হয়ে গিয়েছিল। ইদানীং গন্ধে টেকা যাচ্ছিল না। আমরাই পুলিশে জানাই। কাউন্সিলরও এসেছিলেন।’’
অপূর্ববাবুর মেয়ে অনিন্দিতা বলছিলেন, ‘‘যতটা পেরেছি করেছি। আর কিছু করার ছিল না। তবু বলব, পুলিশ না ডেকে বাড়ির লোকেরা আমায় ফোন করতে পারতেন। বাবা বয়স্ক মানুষ, ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন।’’ সেই সঙ্গে তিনি জানান, আপাতত অপূর্ববাবুকে বাড়িতে নিয়ে যেতে বলা হলেও পায়ে গভীর ক্ষত রয়েছে। ফের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হতে পারে।
হাসপাতালে শুয়ে অপূর্ববাবু অবশ্য আগেই জানিয়েছিলেন, পায়ের ব্যথা কিছু নয়। তিনি দ্রুত বাড়ি ফিরতে চান। বলেছিলেন, ‘‘ছেলে আসবে। জানলার সামনে থাকতে বলেছে। ডাক্তারদের বলুন যেন তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেয়।’’ কথা মতোই কাজ। বাড়ি ফিরেই জেদ করে ফের বসে পড়েছেন জানলার সামনে। ফিরে আসার পথে দেখা গেল, বৃদ্ধের শূন্য দৃষ্টি তখনও রাস্তায় আটকে ছেলের জন্য।