ট্যাংরার ক্রিস্টোফার রোডের হেলে যাওয়া বাড়ির ভাড়াটিয়া রানী প্রসাদ। —নিজস্ব চিত্র।
খোদ মেয়র ফিরহাদ হাকিম, পুরসভার বিল্ডিং দফতর যাঁর অধীনে, তিনি ঘটনার দায় এড়িয়ে গিয়েছেন। দায় এড়িয়েছেন স্থানীয় পুরপ্রতিনিধি সন্দীপন সাহাও। যার পরিপ্রেক্ষিতে ট্যাংরার ক্রিস্টোফার রোডে দু’টি বহুতলের হেলে পড়ার ঘটনায় বুধবার মেয়রের পদত্যাগের দাবি তুলেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বৃহস্পতিবার মেয়র ফোন না ধরায় মেসেজ করে জানতে চাওয়া হয়, শহরে একের পর এক বহুতল বিপর্যয়ের দায় কি তাঁর উপরে বর্তায় না? তিনি তো মেয়র এবং বিল্ডিং দফতরের দায়িত্বে। জবাব অবশ্য আসেনি।
এ দিন হেলে পড়া দু’টি ছ’তলা বহুতল পরীক্ষা করে গিয়েছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন এবং কলকাতা পুরসভার এক জন, মোট দু’জন স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার। যে বহুতলে বাসিন্দারা আছেন, সেটির ছাদ থেকে নীচ পর্যন্ত ‘ওলোন দড়ি’ ঝুলিয়ে দেন তাঁরা, যাতে বোঝা যায়, বাড়িটি আরও হেলে পড়ছে কিনা। পাশের বহুতলটিও পরীক্ষা করেন তাঁরা। পরে তাঁরা জানান, পুর কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে শীঘ্রই রিপোর্ট পেশ করবেন। বাড়ি দু’টি ভেঙে ফেলার বিষয়ে তার পরেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেল, হেলে পড়া বাড়ি দু’টি ঘিরে নিজস্বী তোলার ভিড়। বেশি হেলে পড়া বাড়িটিতে আবাসিকেরা এখনও বসবাস করছেন। তিনটি ভাড়াটে পরিবার অবশ্য বুধবারই অন্যত্র চলে গিয়েছে। আবাসনের জল ও বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল আগেই। পুরসভার দেওয়া নোটিসে বলা আছে, তিন দিনের মধ্যে বাড়ি খালি না করলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আবাসিকদের পাল্টা বক্তব্য, ‘‘অনেক কষ্টে ফ্ল্যাট কিনেছি। আমাদের থাকার বিকল্প জায়গা নেই। কেউ ঘাড় ধরে আমাদের বার করতে পারবে না।’’ ওই বাড়ির দোতলায় থাকেন রীনা সেনগুপ্ত। তাঁদের জমিতেই বাড়িটি তৈরি হয়েছে। রীনা বলেন, ‘‘জল কিনে খাচ্ছি। পুরপ্রতিনিধি আশ্বাস দিয়েছেন, কাল জল ও বিদ্যুৎ সংযোগের অস্থায়ী ব্যবস্থা করা হবে।’’ চারতলায় স্বামী, বৃদ্ধা শাশুড়ি ও শিশুপুত্রকে নিয়ে ভাড়া থাকেন বাণী প্রসাদ। সামনেই বস্তির এক চিলতে ঘরে বাণীর শ্বশুরবাড়ি। তাঁর কথায়, ‘‘স্বামীর গাড়ির ব্যবসা। শ্বশুরবাড়ির ঘুপচি ঘরে থাকতে সমস্যা হচ্ছিল বলেই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলাম। এ বার অন্যত্র চলে যাব।’’ চারতলার অপর বাসিন্দা কৃষ্ণা সেনগুপ্ত বললেন, ‘‘সারা রাত আতঙ্কে ঘুম হয়নি। আলো নেই, জল নেই। আজ স্নানও করিনি। কেনা জল নিয়ে শৌচাগারে যাচ্ছি। এ ভাবে কত দিন চলবে, জানি না।’’
এ দিকে, হেলে পড়া দুই বহুতলেরই প্রোমোটারেরা বেপাত্তা। তাঁদের ফোনও বন্ধ। স্থানীয় পুরপ্রতিনিধি জানান, প্রোমোটারদের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এ দিনও পুরসভার বিল্ডিং দফতরের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগ, ‘‘এখানে বেশির ভাগ নির্মাণই বেআইনি। হেলে পড়া একটি বাড়ির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে বছরখানেক আগে। অন্যটির নির্মাণকাজ শুরু হয় চার বছর আগে। দু’টি বাড়িই বেআইনি। পুরসভার বিল্ডিং দফতর আগেভাগে ব্যবস্থা নিলে এত বড় বিপর্যয় ঘটত না।’’
একের পর এক বাড়ির হেলে পড়া এবং বেআইনি নির্মাণ প্রসঙ্গে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এ দিন বলেন, “বাড়ি তৈরির সময়ে কাটমানি, ফ্ল্যাট-পিছু টাকা বুঝে নেওয়ার সময়ে পুরসভা, পুরপ্রতিনিধি, মেয়র— সবাই আছেন। টাকা তোলা হয়ে গেলে সব উধাও। আর কারও কোনও দায় নেই। অপদার্থকে মেয়র বানালে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা না করাই ভাল।” বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘‘কাটমানি নিয়েছে, বাড়ি তুলেছে। জমির প্রকৃতি কেমন, প্ল্যান ঠিক আছে কিনা, ভিত কেমন, চারপাশে নিয়মমাফিক জমি ছাড়া হয়েছে কিনা— কিছুই দেখা হয়নি।’’
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর অভিযোগ, “গার্ডেনরিচে বাড়ি ভেঙে মানুষ মারা গেলেন। আর পুরপ্রতিনিধির গাড়ির দাম দেখা গেল, পাঁচ কোটি টাকা। বাঘা যতীন, কামারহাটি, ট্যাংরাতেও একই ছবি। জলাজমি ভরিয়ে বাড়ি, বেআইনি নির্মাণ, টাকার বিনিময়ে বাড়ির অনুমোদন— তৃণমূলের রাজত্বে এই সবই সত্য।” প্রদেশ কংগ্রেসের মুখপাত্র সৌম্য আইচ রায়ও বলেন, “অনুপ্রেরণার উন্নয়ন! আইন শিকেয় তুলে তৃণমূলের নেতা, নির্মাণ ব্যবসায়ীরা শুধু কাটমানি লেনদেন করে মানুষের জীবন বিভীষিকাময় করে তুলেছেন। তৃণমূলের নেতাদের টাকা দিলে খাল কেটে খিদিরপুর বন্দর থেকে জাহাজ নির্মাণ ব্যবসায়ীর বাড়িতেও পৌঁছে দেবে।”