প্রথমে চিহ্নিত করে নেওয়া, কোথায় কোথায় ‘অভিযান’ চালানো দরকার।
তার পরে সেই মতো সেখানে সেখানে ‘বাহিনী’ মোতায়েন করে এলাকার ঘাঁতঘোঁত বুঝে নেওয়া। একই সঙ্গে ক্রমাগত হুমকিতে শত্রুশিবিরের মনোবল গুঁড়িয়ে দেওয়া। তাতে কাজ হলে ভাল। না হলে ভোটের দিন সন্ত্রাসের তুবড়ি ছোটানো।
ম্যাপিং-থ্রেটনিং-ভোটিং!
দুর্বল ওয়ার্ডগুলোয় বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করে ভোটবাক্সে নিরঙ্কুশ আধিপত্য কায়েমের তিন দফা তৃণমূলী কৌশল। শনিবারের পুরভোটে যে ‘ত্রিফলা’র সফল প্রয়োগ দেখেছে শহর কলকাতা। পুলিশ-সূত্রেও মিলছে তার সমর্থন।
এবং দলীয় সূত্রের খবর, শেষোক্ত দুই দফার কর্মসূচি রূপায়ণের স্বার্থে বিপুল সংখ্যক বহিরাগত ‘সৈনিকের’ ভরণপোষণের দায়ভারও সংগঠনের ঘাড়ে বর্তেছে। মাথাপিছু দৈনিক বেরিয়ে গিয়েছে অন্তত হাজার টাকা! অধিকাংশ ক্ষেত্রে বহিরাগতদের নিরাপদ আস্তানা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল স্থানীয় কর্মীদের বাড়ি। কোথাও কোথাও পাড়ার ক্লাবঘর। সেখানে কয়েক দিনের দেদার খানাপিনা, মোটরসাইকেলের তেলের টাকাও জোগাতে হয়েছে।
তৃণমূলের অন্দরের খবর: এই সব ‘কর্মযজ্ঞের’ পিছনে অনেক ওয়ার্ডে খরচ ২৫ লক্ষও ছাড়িয়ে গিয়েছে! ব্যাপক হারে, কার্যত খুল্লম-খুল্লা ছাপ্পা ভোট ও রিগিং করার উদ্দেশ্য নিয়ে বহিরাগতদের যে এ ভাবেই বিভিন্ন ওয়ার্ডে জড়ো করা হয়েছিল, স্থানীয় পুলিশ-সূত্রও তা স্বীকার করেছে।
তৃণমূলের এক সূত্রে জানা যাচ্ছে, ভোটের দিন কুড়ি আগেই নেতারা আঁচ পেয়েছিলেন, বেশ কিছু ওয়ার্ডে খারাপ ফল হতে পারে। সেই বাছাই তালিকায় যাদবপুর লাগোয়া ১০১ থেকে ১১৪ নম্বর ও তিন নম্বর বরোর বেলেঘাটা-মানিকতলা-কাঁকুড়গাছির পাশাপাশি এমন কিছু ওয়ার্ডও ছিল, যেখানে লোকসভা ভোটের ফলের নিরিখে বিজেপি সুবিধেজনক অবস্থায়। তখনই ঠিক হয়, দলের ‘ডাকাবুকো সৈনিকদের’ এনে ওই সব ওয়ার্ডে ‘ম্যাচ’ বার করে আনতে হবে।
সেই মতো ‘সৈনিক’ পাঠানোর জন্য কলকাতা লাগোয়া বিভিন্ন জেলার নেতাদের কাছে নির্দেশ যায়। তৃণমূলের এক নেতা জানাচ্ছেন, ‘‘দু’রকম দল ছিল। নিশ্চিত হারের ওয়ার্ডে শ’দেড়েক ছেলে-মেয়ের এক-একটা মডিউল। আর যেখানে হারার সম্ভাবনা, মানে ফিফটি-ফিফটি ওয়ার্ডে জনা পঞ্চাশেকের দল।’’
ওঁদের কৌশল কাজ করেছে কী ভাবে?
দলের খবর: ভোটের দিন সাতেক আগে থেকে স্থানীয় দু’-এক জন কর্মী নিয়ে বহিরাগতেরা অঞ্চল টহল দিতে শুরু করে। বোরোয় বাইক-বাহিনী। তাদের প্রধান কাজ ছিল নিয়মিত বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে শাসানো। পাশাপাশি এলাকার অলিগলি চিনে নেওয়া। পয়লা হুমকিতে কাজ না-হলে ‘পিটিয়ে সিধে’ করার নির্দেশও ছিল। প্রহারে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়া বা বন্দুক ধরে হুঙ্কারের ঢালাও অনুমতি দিলেও নেতারা কিন্তু পইপই করে সাবধান করে দিয়েছিলেন, বোমা-গুলি যেন ভুলেও চালানো না হয়। ‘‘সেটা তোলা ছিল ফাইনাল রাউন্ডের জন্য।’’— মন্তব্য এক সৈনিকের।
তৃণমূল সূত্রের খবর: যাদবপুর লাগোয়া ওয়ার্ডে ‘অপারেশন’ চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় ভাঙড়ের দুই প্রভাবশালী নেতাকে। ভাঙড় ছাড়াও তাঁরা মহেশতলা-বজবজ-বামনঘাটা থেকে বাহিনী জড়ো করেন। ১০৯ নম্বর ওয়ার্ডের শহিদস্মৃতি, ভরত সিংহ কলোনি, ১০৮ নম্বরের উত্তর পঞ্চানন গ্রাম, ১০১ নম্বরের ফুলবাগান জলট্যাঙ্ক, বিননগর, রবীন্দ্রপল্লি খালপাড়, কেন্দুয়া ও ১১০ নম্বরের উপনগরীতে ভোটের দিন সাতেক আগেই হুমকি ও প্রয়োজনে মারধরের পালা শুরু হয়ে যায়।
আর ভোটের দিন?
সকালে বিরোধী দলের এজেন্টকে পিটিয়ে বার করা দিয়ে সূচনা। খানিক বাদে বহিরাগত বাহিনীকে মূলত ভোটকেন্দ্রের বাইরে মোড়ের মাথায় দাঁড় করিয়ে রেখে তামাম তল্লাটে চাপা সন্ত্রাস তৈরি করা হয়। অনেক জায়গায় বেলা একটার পরে বুথ চলে গিয়েছে এই বাহিনীর কব্জায়। দরজা বন্ধ করে ভোটার তালিকা মিলিয়ে একের পর এক ভোট পড়েছে! যদিও এ সব ক্ষেত্রে ইভিএমের বোতাম টিপেছেন দলের বিশ্বস্ত কোনও নেতা। কোথাও অভিযোগ, ভোটারের হাতে কালি লাগিয়ে তাঁর হয়ে ভোটটি দিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় নেতা!
প্রতিরোধেরও বালাই ছিল না। রবিবার যাদবপুরের এক সিপিএম নেতা বলেন, ‘‘ভোট শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে জনা পঞ্চাশেকের একটা দল এসে আমাদের বুথক্যাম্প ভেঙে হুমকি দিয়ে চলে গেল! তখনও আমরা বুথ কামড়ে পড়ে ছিলাম। ঘণ্টাখানেক বাদে প্রায় দু’শো জনের দল এসে পুলিশের সামনেই বন্দুক দেখাল! কাউকে কাউকে বেধড়ক মারলও!’’
ওখানেই প্রতিরোধের ইতি! রণে ভঙ্গ দিলেন ওঁরা! একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে হয়েছে শনিবার। কলকাতার সংযোজিত এলাকায় শাসকদলের পক্ষে একটি ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক যুব তৃণমূল নেতার পর্যবেক্ষণ, ‘‘গত বারের তুলনায় ভোট কম পড়েছে। কারণ, মানুষ বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখতে পেয়েছেন, বাইরের যে সব ছেলেরা আগের দিন শাসিয়ে গিয়েছিল, তারাই বুথের বাইরে দাঁড়িয়ে! ফলে অনেকেই ভোট না-দিয়ে ফিরে গিয়েছেন।’’
আর এতে তৃণমূলের লাভ হয়েছে বলে যুব নেতাটি দাবি করলেও শাসকদলেরই একটি অংশ সিঁদুরে মেঘ দেখছে। কী রকম?
তৃণমূলের এই অংশের মতে, শনিবারের ভোটে যে রকম গা জোয়ারি হল, তা গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক। ‘‘সিপিএমের সায়েন্টিফিক রিগিংয়ের প্রতিবাদে মানুষ আমাদের ভোট দিয়েছিল। আমরা সেই কাজ করলে সাময়িক ভাবে লাভ হলেও দীর্ঘ মেয়াদে মানুষের সঙ্গে দূরত্ব বাড়বে।’’— বলেন দলের দক্ষিণ কলকাতার এক নেতা। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এ সব করে এক বার হয়তো পুরসভা জেতা যায়। আখেরে কিন্তু ক্ষতি আমাদেরই।’’
অন্য অংশ শুনছেন কি না, সেই সংশয়টাও গোপন রাখেননি তিনি।