গত সপ্তাহে সিটি কলেজে একটি টিকাকরণ শিবির চলাকালীন দেবাঞ্জন দেব। নিজস্ব চিত্র।
ভুয়ো ভ্যাকসিন শিবিরের গোড়া থেকেই পুরসভা এবং পুলিশের একাংশের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ উঠেছিল। এ বার সেই অভিযোগকে আরও জোরালো করল স্থানীয় ওয়ার্ড কো-অর্ডিনেটর সুশান্ত ঘোষের বক্তব্য। পুরসভার একাংশ এবং স্থানীয় বিধায়ক জাভেদ খান দাবি করেছিলেন, কো-অর্ডিনেটরের অজ্ঞাতে এ ধরনের ক্যাম্প চলতে পারে না।
সুশান্তবাবু শুক্রবার পাল্টা দাবি করেছেন, তিনি এই ধরনের ক্যাম্পের খবর পাওয়া মাত্রই পুরসভার স্পেশ্যাল কমিশনার, স্বাস্থ্য বিভাগ এবং স্থানীয় থানায় জানান। এমনকি, পুরসভার স্থানীয় ওয়ার্ডের ভারপ্রাপ্ত মেডিক্যাল অফিসার টিকাকরণ ক্যাম্পেও গিয়েছিলেন। তার পরেও কী ভাবে ক্যাম্প চলল তার সদুত্তর কো-অর্ডিনেটরের কাছেও মেলেনি।
সুশান্তবাবুর বক্তব্য, তিনি ঘটনার দিন বেলা ১১টা নাগাদ পুরসভার ডেপুটি সিএমওএইচ তরুণ সাঁপুইকে ফোনে এই ক্যাম্পের কথা জানান। তরুণবাবু স্থানীয় মেডিক্যাল অফিসারকে ঘটনাস্থলে পাঠান। নিয়ম অনুযায়ী, মেডিক্যাল অফিসারেরই ক্যাম্প পরিদর্শন করে পুরসভাকে জানানোর কথা। সুশান্তবাবুর আরও দাবি, তিনি কসবা থানার ওসিকেও বিষয়টি জানিয়েছিলেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে অনুরোধ করেন। তার পরে পুলিশ সক্রিয় হয়েছিল কি না, তার উত্তর তিনি দেননি। সুশান্তবাবুর দাবি, তিনি পুরসভার বিশেষ কমিশনার তাপস চৌধুরী এবং সচিব হরিহর প্রসাদকেও ফোনে বিষয়টি জানান।
তরুণবাবু পাল্টা জানিয়েছেন, ওয়ার্ড কো-অর্ডিনেটর বেলা ১টা ৪ মিনিটে ফোন করেন এবং ক্যাম্পের খবর জানান। কলকাতা পুরসভার প্রশাসক মণ্ডলীর প্রধান ফিরহাদ হাকিমেরও দাবি, ক্যাম্পের বিষয়ে পুরসভা খবর পায় বেলা দেড়টা নাগাদ। তার পরে পুরসভার দিক থেকে যা করণীয় তা করা হয়েছে। তরুণবাবু জানান, তিনি বেলা দেড়টা নাগাদ ওয়ার্ডের ভেক্টর কন্ট্রোল ইনচার্জ বা ভিসিআই-কে (মেডিক্যাল অফিসার নয়) পাঠান। ভিসিআই ঘটনাস্থলে যান এবং নিজের ফোন থেকে দেবাঞ্জন দেবের সঙ্গে তরুণবাবুর সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। তরুণবাবুর দাবি, তিনি দেবাঞ্জনকে ওয়ার্ড কো-অর্ডিনেটরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। দেবাঞ্জন তাঁকে জানান, ওই ক্যাম্পে খোদ মেয়রের আসার কথা রয়েছে। তরুণবাবুর দাবি, ওই ক্যাম্প সম্পর্কে তিনি আর কোনও খোঁজ পাননি। রাতে ওয়ার্ড কো-অর্ডিনেটর তরুণবাবুকে জানান, ভুয়ো ক্যাম্প চালানোর অভিযোগে দেবাঞ্জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
দেব-লীলা: কেউ কিছুই জানতেন না, কেউ কিছুই দেখেননি
• গাড়িতে নীল বাতি, বিশ্ব বাংলার লোগো
• নিজেকে পুরসভার যুগ্ম কমিশনার পরিচয় দেওয়া
• নবান্নের জাল লেটারহেডে ব্যক্তিগত রক্ষী নিয়োগ
• বিভিন্ন ধরনের নথি জালিয়াতি
• পুরসভার অফিসারের সই জাল করে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা
• পুরসভার নথি জাল করে বাগড়ি থেকে ওষুধ ক্রয়
• শিয়ালদহ থেকে কোভিশিল্ড, স্পুটনিকের জাল লেবেল ছাপানো
• বিভিন্ন জায়গায় সরকারি ব্যানার টাঙিয়ে ভুয়ো টিকাকরণ শিবির
• টিকা দেওয়ার নামে একটি সংস্থা থেকে ১.১১ লক্ষ টাকা হাতানো
• স্টেডিয়ামের বরাত দেওয়ার নামে এক ঠিকাদারের কাছ থেকে ৩৬ লক্ষ টাকা নেওয়া
• টেন্ডার পাইয়ে দেওয়ার আশায় বেহালার এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১০ লক্ষ টাকা নেওয়া
সূত্র: কলকাতা পুলিশ
তবে এক জন ভুয়ো আইএএসের সঙ্গে কথা বললেও পুরকর্তার কেন সন্দেহ হল না সেই প্রশ্ন উঠেছে। তরুণবাবুর দাবি, তাঁর সন্দেহ হয়েছিল। তা হলে সে সময়ই তিনি পদক্ষেপ করলেন না, সেই প্রশ্নও উঠেছে।
পুরসভার যে জয়েন্ট কমিশনার পরিচয় দিয়েছিল দেবাঞ্জন দেব সেই পদটি প্রায় দশ বছর আগে বাতিল করা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এমন এক অস্তিত্বহীন পদ আঁকড়ে দেবাঞ্জন একাধিক ভুয়ো টিকাকরণ শিবির করে গেলেও পুরসভা জানল না কেন?
এ প্রসঙ্গে ফিরহাদের বক্তব্য, পুলিশ যে ভাবে কাজ করে বা খবর রাখে, তা পুরসভার পক্ষে করা সম্ভব নয়। পুরসভা কোনও তদন্তকারী সংস্থা নয়। যখন কোনও বেসরকারি হাসপাতাল প্রতিষেধক ক্যাম্প করছে, তখন তো পুরসভার কাছে আসছে না। তারা নিজেদের উদ্যোগে ও ব্যবস্থাপনায় করছে। পুরসভার নিজের কিছু শিবির আয়োজন করছে। কিন্তু, অন্য কে কোথায় কী হচ্ছে, তার সন্ধান করা পুরসভার কাজ নয়।
নবান্নের একটি সূত্রের খবর, বিভিন্ন স্তরে পুলিশের কী ভূমিকা ছিল তাও আতস কাচের তলায় আনা হতে পারে। সামগ্রিক ভাবে পুলিশ যে সময় মতো উপযুক্ত তৎপরতা দেখায়নি, তেমন ধারণা নবান্নের উপর মহলে তৈরি হয়েছে। এখন খবর জানাজানি হওয়ার পরে বিভিন্ন মহল সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তালতলায় ত্রিপুরা শঙ্করসেন শাস্ত্রী স্মৃতি গ্রন্থাগারের ফলকে রাজ্যের নেতা,মেয়র, বিধায়ক, সাংসদদের সঙ্গে নাম ছিল দেবাঞ্জনেরও। আর সেই ঘটনা নিয়ে শুক্রবার তালতলা থানায় এলাকার তৃণমূল বিধায়ক নয়না বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ জানিয়ে বলেন, অনুমতি ছাড়াই তাঁর নাম ব্যবহার করা হয়েছে ওই ফলকে। পুলিশ ওই সংস্থার প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
এ দিকে ফেসবুকে ৩০ অক্টোবর পোস্ট করা একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সে দিন কলকাতা পুরসভার কনফারেন্স হলে তদানীন্তন মেয়র ফিরহাদ দেবাঞ্জনকে দেখে দু’হাত তুলে নমস্কার করছেন। এ প্রসঙ্গে ফিরহাদ বলেন, ‘‘ করোনার সেই সময়ে বহু মানুষ আমার কাছে মাস্ক, স্যানিটাইজার দিতে আসতেন। ওকে আমি চিনতামই না।’’
মুচিপাড়া থানাতেও এ দিন দেবাঞ্জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছেন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (আইএমএ)-র প্রাক্তন সর্বভারতীয় সভাপতি শান্তনু সেন। রাত পর্যন্ত কোন মামলা রুজু না হলেও পুলিশ অভিযোগটি খতিয়ে দেখছে বলে সূত্রের খবর।
জানা গিয়েছে, কসবার ওই টিকাকরণ ক্যাম্পে কোনও চিকিৎসক ছিলেন না। নিয়মমতো টিকা নেওয়ার পর প্রত্যেকে এক ঘণ্টা নজরদারিতে রাখা হয়। তখন কেউ অসুস্থ হলে ওই চিকিৎসক তাঁকে দেখবেন। বেসরকারি ক্লিনিকের সঙ্গে যুক্ত এক পুরুষকর্মী ছিলেন শুধু ইঞ্জেকশন দেওয়ার জন্য।
যে বেসরকারি ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলে মোটা টাকার লেনদেন করত দেবাঞ্জন, এ দিন অতীন ঘোষ জানান, ওই বেসরকারি ব্যাঙ্ক কলকাতা পুরসভার সই, স্ট্যাম্প ভালো করে খতিয়ে না দেখে কী ভাবে এই ধরনের অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমোদন দিল, তার জন্য পুরসভা ওই ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করছে।
অভিযোগ থেকে রেহাই নেই পুলিশেরও। প্রশ্ন উঠেছে, কঠিন সময়ে থানায় থানায় মাস্ক, স্যানিটাইজ়ার বিলি করার পরিচিতির জোরেই কি এত দিন পুলিশের নজরের বাইরে ছিল দেবাঞ্জন দেব? যার বিরুদ্ধে আগেই অভিযোগ দায়ের হয়েছে, এমন এক জন কী করে দিনের পর দিন প্রতিষেধক ক্যাম্পের আয়োজন করে গেল, উত্তর মিলছে না সেই প্রশ্নেরও। যে যে এলাকায় ক্যাম্পগুলি হয়েছে, সেখানকার থানা কী একেবারেই অন্ধকারে ছিল, মিলছে না এই প্রশ্নের উত্তরও।
শুক্রবার লালবাজারের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) মুরলীধর শর্মা এই তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে কথা বললেও এই প্রশ্নগুলি এড়িয়ে গিয়েছেন। এমনকি আগে থেকে কোনও অভিযোগ দায়ের হওয়া সম্পর্কেও তিনি মন্তব্য করতে চাননি।
যদিও কলকাতা পুলিশ সূত্রের খবর, গত ১৫ জুনই দেবাঞ্জনের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ জমা পড়েছিল পুলিশের কাছে। কলকাতা পুরসভার কমিশনারও এই ভুয়ো আইএএসের বিরুদ্ধে নিউ মার্কেট থানায় অভিযোগ করেছিলেন বলে খবর। যদিও ওই অভিযোগগুলি ‘কনটেন্ট নট ভেরিফায়েড’ হয়েই থানায় এতদিন পড়ে ছিল বলে খবর।
এর পর প্রথম দেবাঞ্জনের বিরুদ্ধে কসবা থানায় অভিযোগ জমা পড়ে ২২ জুন। কিন্তু প্রশ্ন, কসবায় দিনের পর দিন যে এই ধরনের একটি ক্যাম্প চলছে তা কি জানত না কসবা থানা? ওই থানার এক আধিকারিক অবশ্য জানালেন, পুলিশ মহলে পরিচিত মুখ ছিল দেবাঞ্জন। তার সংস্থা ক্যাম্প করছে বলে থানার আধিকারিকদের উপস্থিত থাকার জন্য একটি আমন্ত্রণপত্র জমা করা হয়েছিল থানায়। কিন্তু ‘চেনা লোকের’ অনুষ্ঠান বলে পুলিশ আর বিষয়টি নিয়ে মাথাই ঘামায়নি। থানা থেকে কেউ আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে যানওনি। অভিযোগ, একই কাণ্ড হয়েছিল আমহার্স্ট স্ট্রিটের সিটি কলেজের প্রতিষেধক ক্যাম্পের ক্ষেত্রেও। আমহার্স্ট স্ট্রিট থানাকে ওই কলেজ কর্তৃপক্ষের তরফেই আমন্ত্রণ জানানো হলেও, কী ধরনের ক্যাম্প হচ্ছে তা আর দেখতে যাওয়া হয়নি থানার তরফে। এর পর গত বৃহস্পতিবার কলেজের তরফে লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পরে নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ।