অবসর: আড্ডার মেজাজে তং। বৃহস্পতিবার, চিনা পাড়ায়। নিজস্ব চিত্র
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে তখন। ট্যাংরার রোয়াকে বসে গল্পে মশগুল দুই চিনা বৃদ্ধ। তবে সেখানে কোথাও নেই লাদাখের গালওয়ান উপত্যকা বা চিন-ভারতের যুদ্ধ পরিস্থিতির কথা। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কী ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে চিনা রেস্তরাঁগুলি— হিন্দিতে সেই আলোচনাতেই ব্যস্ত দু’জনে।
এ শহরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বসবাসকারী চিনা নাগরিকদের জীবনে চিনের ছোঁয়া রয়ে গিয়েছে শুধু নাম, পদবি কিংবা মুখের আদলেই। বাকিটা আর পাঁচ জন বাঙালির মতোই। ‘এ শহর জানে আমার প্রথম সব কিছু’— কলকাতা সম্পর্কে এ কথা বলতেই পারেন তাঁরা। তাই চিন-ভারত বিবাদে মাথা না-ঘামিয়ে রকে বসে তাস পেটানো বা আড্ডাতেই তাঁদের বেশি আগ্রহ। সাউথ ট্যাংরা রোডের রোয়াকে বসে বৃহস্পতিবার তং জানালেন, ৬৪ বছর আগে বাবার হাত ধরে তাঁর এখানে আসা। চাউমিনের ছোট্ট দোকান খুলেছিলেন তাঁর বাবা। সেই দোকানই সামলাচ্ছেন তং। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আর এক জন বলছেন, ‘‘আমার তিন পুরুষ এই মাটিতেই শেষ শয্যা নিয়েছে। এই মাটিই তো আমার দেশের মাটি!’’ অল্প বৃষ্টিতেই জলমগ্ন হওয়া, কাঁচা নর্দমার ট্যাংরা এলাকাকে চোখের সামনে বদলাতে দেখেছেন তাঁরা। এখন চিনা বর্ষবরণে ড্রাগন নাচ থেকে দুর্গাপুজো, কালীপুজো, বড়দিন— এ সব নিয়েই মশগুল তাঁদের নতুন প্রজন্ম। ভালবাসার এই শহরই আদতে চিন থেকে শিকড় উপড়ে আসা মানুষগুলির ভাল-বাসা!
ট্যাংরার বাসিন্দা অ্যালফ্রেড হুয়ে আবার বলছেন, ‘‘আমি নামেই চিনা। আমার জন্ম এ দেশে, আমি তো ভারতীয় নাগরিকই। এই শহর তো আমার শহর। আমার বাবাও কোনও দিন চিনে যাননি। রেস্তরাঁ কী ভাবে চালাব, এখন সেটাই একমাত্র চিন্তা।’’
আরও পড়ুন: মেডিক্যালের গ্রিন বিল্ডিংয়েও করোনা রোগী ভর্তি শুরু
লাদাখের উত্তপ্ত পরিস্থিতির আঁচ পড়েনি ট্যাংরার প্রতিবেশীদের মধ্যেও। সেখানকার এক বাঙালি দোকানদার শম্ভু মণ্ডল বলছেন, ‘‘এঁরা সকলেই আমাদের আপনজন। ওঁদের কেউ কিছু বললে আমরা রুখে দাঁড়াব।’’
‘নীল আকাশের নীচে’ সিনেমায় এই আত্মীয়তার ছবিই তো দেখিয়েছিলেন পরিচালক মৃণাল সেন— ফেরিওয়ালা ওয়াং লুয়ের সঙ্গে বাঙালি তরুণী বাসন্তীর আত্মীয়তার সম্পর্ক। ত্রিশের দশকের পটভূমিকায় তৈরি সেই গল্পের বহু আগে, অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে বজবজের কাছে চিনির কলে কাজ করতে এ শহরে আসেন চিনারা। তাঁদের একাংশ চলে আসেন বৌবাজারে।
আরও পড়ুন: লকডাউনে করা গেল না পরিযায়ী পাখিদের গণনা
ইতিহাস বলছে, চতুর্থ খ্রীস্টাব্দে ফা-হিয়েন ছিলেন প্রথম চিনা বৌদ্ধ তীর্থযাত্রী এবং অনুবাদক, যিনি প্রথম এ দেশে আসেন। সপ্তম খ্রীস্টাব্দে আসেন চিনা পর্যটক-অনুবাদক হিউয়েন সাং। তাঁদের ভ্রমণবৃত্তান্তে তাম্রলিপ্ত-সহ ভারতের বহু জায়গার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁরা। বিংশ শতকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে তৈরি করান চিনা ভবন। ১৯৩৭ সালের ১৪ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথ ও অধ্যাপক তান-উন-সানের উপস্থিতিতে এই ভবনের পথ চলার শুরু। এটি বিশ্বব্যাপী সৌভ্রাতৃত্বের অন্যতম নিদর্শনও বটে। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ আনন্দ ইয়ংয়ের জন্মও এই রবি ঠাকুরের আশ্রমেই।
প্রবীণ আশ্রমিকেরা জানাচ্ছেন, ১৯৬২ সালের চিন-ভারত যুদ্ধের পরে বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে এসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য জওহরলাল নেহরু লিখেছিলেন, প্রতি বছর এই অনুষ্ঠানে আসার জন্য কী ভাবে অপেক্ষা করে থাকেন তিনি। সে বার সেখানে চিনা ভবনের অধ্যক্ষকে (তান-উন-সান) দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নেহরু তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নেন। তৈরি হয় নজির।
তবে এটাও সত্যি যে, ১৯৬২ সালের চিন-ভারত যুদ্ধের সময়ে চিনাদের কারও কারও উপরে নির্যাতন হয়েছে। কিন্তু সে ক্ষত ভালবাসার প্রলেপে ভুলিয়েছে কলকাতা। তাই বাঙালি যুবকের জাপানি বৌ নিয়ে উপন্যাস হলেও চিনে-বাঙালির বিয়ে নেহাত রূপকথা নয়। কলকাতার চিনা খাবারেও যেন বাঙালিত্ব জড়িয়ে গিয়েছে।
তাই লাদাখ পরিস্থিতিতেও আবহ বদলায় না এ শহরের চিনাপাড়ায়। ট্যাংরায় দুই চিনা ও বাঙালি প্রৌঢ়া আক্ষেপ করেন— ‘‘ও সব যুদ্ধ-টুদ্ধ কিছু নয়। করোনার দাপটে সন্ধ্যার আড্ডাটাই লাটে উঠেছে! কবে যে স্বাভাবিক হবে!’’