উদ্ধার: আমপানে ঘরহারা মৌটুসি পাখির ছানা। নিজস্ব চিত্র
ঘূর্ণিঝড় আমপানের তাণ্ডবে সর্বত্র তছনছের ছবি। ঝড়ে উড়ে গিয়েছে ওদের ঘর-বাড়িও। কিন্তু, ওদের জন্য খোলেনি কোনও আশ্রয় শিবির। সবে নির্মাণসামগ্রী জড়ো করা শুরু করেছিল ওরা। তার মধ্যেই ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে সব। ফলে নতুন করে বাসা বাঁধার সুযোগই পায়নি চড়াই, শালিক, বেনেবৌ, পেঁচা, কাঠঠোকরা, টুনটুনির দল। পক্ষীপ্রেমীদের দাবি, ঘরহারা মানুষদের মতোই এই মুহূর্তে ঠিকানাহীন অজস্র পাখিও।
দক্ষিণ কলকাতার রবীন্দ্র সরোবর, পূর্ব কলকাতার সুভাষ সরোবরের মতো সবুজে ঘেরা জায়গায় টিয়া, বসন্তবৌরি, ময়না, বেনেবৌ, পেঁচা, কাঠঠোকরা-সহ অজস্র প্রজাতির পাখির বাস। এ ছাড়াও শহরের বহু গাছের কোটরে, শাখায় পাখির বাসা ছিল। শুধু কলকাতা শহরেই প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার গাছ পড়ে যাওয়ার পরে ওই পাখিরা কোথায় আশ্রয় নেবে, সেটাই এখন ভাবাচ্ছে পক্ষীপ্রেমী এবং পরিবেশকর্মীদের।
কেএমডিএ সূত্রের খবর, বিভিন্ন প্রজাতির দু’শো গাছ ভেঙেছে রবীন্দ্র সরোবরে। যেগুলিতে পাখিদের বসতি ছিল। কেএমডিএ-র এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘লকডাউনের জন্য পক্ষীপ্রেমীরা সরোবর চত্বরে যেতে না-পারায় পাখিদের সামগ্রিক অবস্থা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। পিট্টা নামে এক ধরনের পাখি প্রচুর ছিল সরোবর চত্বরে। তাদের সংখ্যা এখন বেশ কম লাগছে। তবে মৃত পাখি আমাদের চোখে পড়েনি।’’ তিনি জানান, ভেঙে পড়া গাছগুলিকে আবার রোপণ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে, সেই সব গাছ শক্তসমর্থ হতে সময় লাগবে। তত দিন বেঁচে থাকার জন্য পাখিদের জীবন-সংগ্রামও বেড়ে যাবে বলেই মনে করছেন পক্ষীপ্রেমীরা। কারণ একটি গাছে বসবাসকারী পাখিরা, বাসাহীন পাখিকে সেই গাছে সহজে বাসা বাঁধতে দেবে না।
পক্ষীপ্রেমী সুদীপ ঘোষের কথায়, ‘‘এই সময়েই পাখিদের বংশবৃদ্ধি হয়। বলা যেতে পরে, এই ঘূর্ণিঝড় পাখিদের একটা প্রজন্মকে শেষ করে দিয়েছে।’’ পক্ষীপ্রেমীদের পর্যবেক্ষণ, পেঁচা থাকে ভাঙাচোরা বাড়ির ঘুলঘুলি, না হয় গাছের কোটরে। চড়াই, শালিক, ঘুঘু, বুলবুলির মতো পাখি এই সময়ে লোকের বাড়িতে বাসা তৈরি করতে পারলেও টিয়া, সানবার্ড, হাঁড়িচাচার মতো বিভিন্ন প্রজাতির পাখিদের বাসস্থানের সমস্যা বেড়ে গিয়েছে। বহু জায়গায় ভেঙে গিয়েছে কাকের বাসাও।
এক পক্ষীপ্রেমী সৌরভ দে জানান, মানুষের সঙ্গে পাখির জীবনেরও কিছু কিছু মিল পাওয়া যায়। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে মানুষ বেড়াতে যায়। নতুন গন্তব্যে পৌঁছে থাকার জায়গা খোঁজে। তেমনই বহু পরিযায়ী পাখি বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই শহরে আসে। উপযুক্ত গাছ ছাড়া সেই সব পাখি নামতেও পারবে না। সৌরভ জানান, আমপানের ঝড়ের পরে কলকাতা এবং লাগোয়া গঙ্গার ধারে টার্ন নামে এক ধরনের পাখি দেখা গিয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘টার্ন মূলত সমুদ্র উপকূল অথবা মাঝসমুদ্রের পাখি। এখনও পর্যন্ত শহরাঞ্চলে তাদের আসার রেকর্ড নেই। আমাদের ধারণা, উপকূলবর্তী এলাকা দিয়ে ঝড় চলে যাওয়ার পরেই আশ্রয়হীন হয়ে তারা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েছে।’’
পক্ষী বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, মূলত গভীর সমুদ্রে থাকে যে সব পাখি, যেমন লেসার ফ্রিগেট বার্ড বা হোয়াইট টেল্ড ট্রপিকবার্ড— আশ্রয়হীন হয়েছে তারাও। এক পক্ষী বিশেষজ্ঞ অর্ক সরকার বলেন, ‘‘ঝড় আসার পরে ওই পাখিরা সমুদ্রেই আটকে পড়েছিল। ঝড়ের পরে উপকূল এবং ভেড়িতে তাদের দেখা মিলেছে।’’ তিনি জানান, প্রায় দেড়শো পাখিকে তাঁরা উদ্ধার করে বন দফতরের হাতে তুলে দিতে পেরেছেন। অর্কবাবুর কথায়, ‘‘প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পাখিদের উদ্ধার করার জন্য যে দল আছে (ইমার্জেন্সি রেসকিউ টিম), তাদের সদস্য সংখ্যা হাতে গোনা। সেই সংখ্যা বাড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। উৎসাহীরাও এগিয়ে আসতে পারেন।’’