শোক: কান্নায় ভেঙে পড়েছেন অজয়ের মা সীতাদেবী। রবিবার, তিলজলার বাড়িতে। নিজস্ব চিত্র
একই দিনে দাদা-বোন দু’জনেই বিয়ের পিঁড়িতে বসবেন বলে ঠিক করেছিলেন। দু’জনের পাত্রপাত্রীও ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার আগেই শনিবার সন্ধ্যার বজ্রাঘাতে তিলজলা রোডের বাড়িতে ফিরল বাড়ির বড় ছেলে বছর পঁচিশের অজয় মল্লিকের মৃতদেহ। পাত্রী মনীষা মল্লিক এসএসকেএম-এর সিসিইউয়ে চিকিৎসাধীন।
শনিবার বিকেলে নিউ মার্কেটে কেনাকাটা করতে গিয়েছিলেন তিলজলা রোডের বাসিন্দা অজয় এবং তাঁর বাগদত্তা মনীষা (১৯)। তার আগেই ময়দানে বেড়াতে গিয়েছিলেন দু’জনে। আচমকা বৃষ্টি শুরু হওয়ায় মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাব সংলগ্ন সেনোটাফের চাতালে ছাতা মাথায় আশ্রয় নেন দু’জনে। আর তখনই বাজ পড়ে ওই এলাকায়। কর্তব্যরত ট্র্যাফিক পুলিশ জানিয়েছিলেন, সেই বাজের ঝলকানিতে তিনি দেখেন লুটিয়ে পড়ে রয়েছে এক যুগল। তাঁর কাছে খবর পেয়ে পুলিশকর্মীরা এসে ট্যাক্সিতে চাপিয়ে দু’জনকে এসএসকেএমে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা অজয়কে মৃত ঘোষণা করেন।
অচৈতন্য মনীষার চিকিৎসা শুরু করার পরে জ্ঞান ফিরলে তাঁর মোবাইল থেকে নম্বর নিয়ে বাড়িতে খবর দেন পুলিশকর্মীরা। জানা যায়, মনীষার বাড়ি প্রগতি ময়দান থানার মাঠপুকুরে। তাঁরা তিন বোন এক ভাই। বাবা স্ট্রোকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত। রাতেই খবর পেয়ে আত্মীয়দের সঙ্গে হাসপাতালে ছুটে আসেন মনীষার মা মালাদেবী। হবু জামাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে ভেঙে পড়েন কান্নায়। মুখে একটাই কথা, ‘‘মেয়ের সঙ্গে এটা কী হল! ছেলের পা-হাতে চোট লাগলেও বুঝতাম। কেনাকাটা করতে গিয়ে এ ভাবে প্রাণটা চলে গেল কেন?’’
আরও পড়ুন: ‘আচ্ছা, ও তো আর নেই! আমি কেন বেঁচে গেলাম?’
মনীষার মায়ের থেকেই অজয়ের বাবার নম্বর নিয়ে তাঁকে খবর দেয় পুলিশ। রাতেই এসএসকেএমে পৌঁছে অজয়ের দেহ শনাক্ত করেন তাঁর বাবা বিনোদ মল্লিক। পুলিশ জানায়, অজয়ের এক বোন ও এক ভাই রয়েছে। অজয়ের মৃত্যুর খবর কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি মা সীতাদেবী। শনিবার হাসপাতালেই ঘন ঘন জ্ঞান হারাচ্ছিলেন তিনি। রবিবার তিলজলা রোডের বা়ড়িতে দেখা গেল, কথা বলছেন না তিনি। মাঝে মধ্যে ডুকরে কেঁদে উঠছেন। পরিজনেরা জানালেন, শনিবার দুপুর একটা নাগাদ বাড়ি ফিরে তিনটে নাগাদ বেরিয়ে যান অজয়। অজয়ের বোন রাখি এ দিন বলেন, ‘‘আমাদের সব শেষ হয়ে গেল।’’
পুলিশ সূত্রে খবর, এন্টালির একটি কলেজের অস্থায়ী কর্মী ছিলেন অজয়। ওই কলেজেরই প্রাক্তন কর্মী তাঁর বাবা বিনোদবাবু। তিলজলা রোডের একটি বাড়ির চারতলার ঘুপচি ঘরে ভা়ড়া থাকে ওই পরিবার। প্রতিবেশীদের থেকে জানা গেল, বাড়ির বড় ছেলে অজয় বছর পাঁচেক আগে ওই কলেজে কাজ পেয়ে সংসারের হাল ধরেছিলেন। ছোট ভাই অজিত স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র। ভাইয়ের পড়াশোনার দায়িত্বও অজয় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। প্রতিবেশীরা জানান, পাড়ায় সকলেই পছন্দ করতেন অজয়কে। কারও কোনও বিপদের খবর পেলে আগে সেখানে ছুটে যেতেন তিনি।
রবিবার সকালেই অজয়ের বাড়িতে যান কলকাতা পুরসভার ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল সভাপতি মাখনলাল দাস। তিনি বলেন, ‘‘অজয়ের পরিবার যাতে ক্ষতিপূরণের টাকা শীঘ্রই পান, সে ব্যবস্থা করব।’’
অন্য দিকে, মনীষা বাড়ির বড় মেয়ে। তিন বোন, এক ভাই আর বাবা-মাকে নিয়েই সংসার। বেশ কিছু দিন আগেই অজয়ের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা সেরে রেখেছিল দুই পরিবার। রবিবার মনীষাকে প্রথমে জরুরি বিভাগের অবজার্ভেশন ওয়ার্ডে রাখা হলেও পরে সিসিইউয়ে স্থানান্তরিত করা হয়েছে বলে পরিবার জানিয়েছে। মনীষার কাকা রাজা মল্লিক বলেন, ‘‘সকালে বলা হল, মনীষা এক দিকের হাত-পা নাড়াচাড়া করতে পারছে না। কথাও বলতে পারছে না। তাই সিসিইউয়ে স্থানান্তরিত করা হবে।’’