—প্রতীকী ছবি।
পর পর চার বার খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছিল তাঁকে। ছোড়া হয়েছিল বোমাও। কিন্তু প্রতি বারই অক্ষত ছিলেন তিনি। তাই ঘনিষ্ঠেরা বলতেন, ‘মণীশ ভাইয়াকে আগে গোলি ভি রুক যাতা হ্যায়।’ কিন্তু ২০২০-র ৪ অক্টোবর পঞ্চম বারে আর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। থানার অদূরেই ‘ব্রাশ ফায়ার’-এ ১৯টি বুলেট ফুঁড়ে দিয়েছিল ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের রাজনীতিতে ‘স্ট্রংম্যান’ হিসাবে পরিচিত, খড়দহের মণীশ শুক্লের শরীর।
এর পরে কেটেছে প্রায় সাড়ে তিন বছর। সিআইডি-র হাতে গ্রেফতারও হয় ১৩ জন দুষ্কৃতী। যাদের মধ্যে তিন-চার জন জামিনও পেয়েছে। সেই ঘটনার পুনরায় তদন্ত চেয়ে ব্যারাকপুরের নগরপাল অলোক রাজোরিয়াকে চিঠি দিলেন মণীশের বাবা চন্দ্রমণি শুক্ল। কারণ, ঘটনার সময়ে সুপারি কিলার সরবরাহে নাম এসেছিল বিহারের বেউর জেলে বন্দি, কুখ্যাত দুষ্কৃতী সুবোধ সিংহের। মঙ্গলবার চন্দ্রমণি বলেন, ‘‘তখন সুবোধকে জেরা করা হয়নি। এখন তো সুবোধকে সিআইডি নিয়ে এসেছে। ওকে জেরা করে প্রকৃত চক্রান্তকারীদের নাম সামনে আনা হোক।’’
চন্দ্রমণির দাবি, ‘‘ছেলেকে খুনের পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য তো ছিলই। কিন্তু কে বা কারা সুপারি দিল, তা এত বছরেও স্পষ্ট হয়নি। তা একমাত্র বলতে পারবে সুবোধ।’’ সূত্রের খবর, তিনটি বাইকে চেপে যে ছ’জন দুষ্কৃতী এসেছিল, তাদের অধিকাংশই শার্প শুটার। প্রত্যেকেই ছিল সুবোধের সঙ্গী। এখন একমাত্র সুবোধই তাঁর ছেলের খুনের ‘ব্লু-প্রিন্ট’ জানাতে পারে বলে দাবি মণীশের বাবার। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘ছ’জনকে ৪০ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হয়েছিল। এত টাকা সুবোধকে দিয়েছিল কে? নেপথ্যে রাজনৈতিক প্রভাবশালী না থাকলে এত টাকা এল কোথা থেকে?’’
চন্দ্রমণির আরও অভিযোগ, ঘটনার পরে চক্রান্তকারী হিসাবে এফআইআরে শাসকদলের কয়েক জন নেতার নাম উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু সিআইডি তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। প্রয়াত ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে ২০২৩ সালের ২৩ অগস্ট আয়োজিত স্মরণ অনুষ্ঠান নিয়ে তিনি ব্যস্ত থাকার সুযোগে চার্জশিট থেকে সুবোধকে ব্যারাকপুর আদালত অব্যাহতি দেয় বলেও অভিযোগ তাঁর। বলেন, ‘‘এটা নিয়ে হাই কোর্টে রিট-পিটিশন জমা করেছি। সুপারি কিলারেরা সুবোধের সঙ্গী জানার পরেও তার নাম বাদ গেল কী করে?’’
বাম জমানার শেষ দিকে ব্যারাকপুরের সাংসদ তড়িৎ তোপদারের হাত ধরে বাম রাজনীতিতে প্রবেশ মণীশের। তখন থেকেই এলাকায় যুবনেতা হিসাবে পরিচিতি। এর পরে তৃণমূল যুব কংগ্রেসের নেতা হিসাবে গোটা শিল্পাঞ্চলেই মণীশ একটা নাম হয়ে ওঠেন। পরবর্তী কালে ভাটপাড়ার তৎকালীন তৃণমূল বিধায়ক অর্জুন সিংহের ‘কাছের লোক’ বলে পরিচিত হন। চন্দ্রমণি বলেন, ‘‘২০১৯-এ এক দিন দলের সমস্যা নিয়ে শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে গিয়েছিল মণীশ। ওর মারাত্মক আত্মসম্মান বোধ ছিল। হয়তো ওই বৈঠকে কোনও কথা খারাপ লেগেছিল। তাই ওই দিন দল ত্যাগ করে।’’ এর পরে অর্জুনের (তখন বিজেপিতে) হাত ধরে বিজেপিতে যোগ দেন মণীশ। তার পরেও মণীশ এলাকায় সব সময়েই পরিচিত ছিলেন ‘বাহুবলী’ রাজনীতিক হিসাবে। তাই মণীশের সঙ্গে ওই এলাকার অন্ধকার জগতের মাথাদের যে যোগাযোগ ছিল, তা স্বীকার করেন অনেকেই। সেখান থেকেই কি কোনও আক্রোশ? না, অন্য কোনও প্রভাবশালীর ‘সমান্তরাল’ শক্তি হয়ে ওঠাই কাল হয়েছিল আইন পাশ ওই যুবকের? উত্তর অধরা।
তবে, ছেলেকে খুনের নেপথ্যে রাজনীতিই সব থেকে বড় কারণ বলে দাবি চন্দ্রমণির। তিনি বলেন, ‘‘মণীশ থাকলে ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে উত্তর ২৪ পরগনার ফলাফল যে অন্য রকম হত, তা সকলেই জানতেন।’’ খুনের দিন মণীশের দুই নিরাপত্তারক্ষী ছুটিতে ছিলেন। এলাকার সিসি ক্যামেরাগুলিও খারাপ ছিল। সেই রহস্যেরও উন্মোচন চায় মণীশের পরিবার। চন্দ্রমণি বলেন, ‘‘খুনে ব্যবহৃত তিনটি বাইক ও কার্বাইন মিলেছিল পানিহাটির বিধায়ক নির্মল ঘোষের বাড়ির অদূরে, রেললাইনের পাশে।’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘দুষ্কৃতীরা বিধায়কের বাড়ির পিছনে সেগুলি ফেলল কেন বা কার নির্দেশে, এটাও সিআইডি-র তদন্ত করে জানা প্রয়োজন।’’ যদিও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি নির্মল। এ দিন চন্দ্রমণি বলেন, ‘‘সব কিছুরই উত্তর মিলতে পারে সুবোধের কাছে। আমরাও সেই আশাতেই আছি।’’