নিহত সজলকুমার কাঞ্জিলাল। লাইনের পাশে পড়ে সজলকুমার কাঞ্জিলালের দেহ(ডানদিকে)। শুক্রবার পার্ক স্ট্রিট ও ময়দান স্টেশনের মাঝে। নিজস্ব চিত্র
তিনি নিজে ঢুকতে পারেননি। ঢুকে গিয়েছিল তাঁর হাত। দরজা খুলে যাওয়ার কথা সঙ্গে সঙ্গেই। তা তো হলই না। ভরসন্ধেয় স্টেশন-ভর্তি লোকের চোখের সামনে হাত-আটকে-ঝুলতে-থাকা যাত্রীকে নিয়েই ছুটতে শুরু করল পাতাল রেল। টানেলের ভিতরে ঘষটাতে ঘষটাতে গিয়ে এক সময় ছিটকে লাইনের ধারেই পড়ে মৃত্যু হল ওই যাত্রীর।
শনিবার সন্ধ্যায় ঘটনাটি ঘটেছে পার্ক স্ট্রিট স্টেশনে। মৃতের নাম সজলকুমার কাঞ্জিলাল (৬৬)। বাড়ি কসবার বোসপুকুর রোডে। তিনি নন্দন চত্বরে লিটল ম্যাগাজিন বিক্রি করতেন। অবিবাহিত সজলবাবু থাকতেন মামাতো ভাই রাজকুমার মুখোপাধ্যায়ের কাছে। দাদার মৃত্যুর জন্য মেট্রো কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে রাজকুমারবাবুর প্রশ্ন, ‘‘হাত আটকে যাওয়া সত্ত্বেও দরজা বন্ধ হল কী করে?
সাম্প্রতিক অতীতে রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে বারবারই প্রশ্নের মুখে পড়েছে কলকাতা মেট্রো। কয়েক মাস আগে আগুন লেগেও আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। তার পরে মেট্রো কর্তৃপক্ষ সার্বিক নজরদারির আশ্বাস দিলেও অবস্থার যে হেরফের হয়নি, এ দিনের মর্মান্তিক ঘটনা তারই প্রমাণ। সজলবাবুর মৃত্যুর পরেও রুটিন বিবৃতি দিয়েছেন মেট্রো কর্তৃপক্ষ। সংস্থার মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘এমন ঘটনা মেট্রো রেলে প্রথম ঘটল। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হবে। দোষীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।’’ যদিও এমন ঘটনা ভবিষ্যতে আর ঘটবে না বলে আশ্বস্ত হতে পারছেন না নিত্যযাত্রীদের বড় অংশ।
এ দিনের ঘটনার পরে ওই ট্রেনের উত্তেজিত যাত্রীরা পার্ক স্ট্রিট স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বিক্ষোভ দেখান। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে আসে কলকাতা পুলিশ এবং মেট্রোর রেল পুলিশের বিশাল বাহিনী। যাত্রীদের অভিযোগ, ওই ব্যক্তিকে টেনে টানেলে টেনে নিয়ে যাওয়ার পরেও হুঁশ ফেরেনি ট্রেনের চালক এবং গার্ডের। এমনকি ওই সময়ে প্ল্যাটফর্মে থাকা আরপিএফ কর্মীরাও ঘটনাটা দেখতে পাননি বলে তাঁদের একাংশের অভিযোগ। যদিও অন্য যাত্রীদের মতে, ট্রেন সজলবাবুকে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় রেলপুলিশ কর্মীরা ছুটে গিয়েছিলেন।
কী ভাবে ঘটল দুর্ঘটনা? প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধে তখন পৌনে সাতটা। পার্ক স্ট্রিট স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম লোকে লোকারণ্য। এসে পৌঁছয় কবি সুভাষগামী ট্রেন। ট্রেনের দরজা যখন বন্ধ হতে চলেছে, তখন ইঞ্জিনের দিক থেকে তিন নম্বর কামরার তিন নম্বর দরজায় ঢোকার চেষ্টা করেন সজলবাবু। তিনি ভিতরে হাত ঢোকাতেই দরজা বন্ধ হয়ে যায়।
সাধারণত এ সব ক্ষেত্রে দরজা ফের খুলে যায়। কিন্তু এ দিন খোলেনি। হাত আটকে যায় সজলবাবুর। ট্রেনও চলতে শুরু করে। দ্রুত গতি বাড়িয়ে ঢুকে পড়ে টানেলের ভিতরে। সজলবাবু তখন হাত আটকানো অবস্থায় দরজা থেকে ঝুলছেন। ধাক্কা খাচ্ছেন টানেলের দেওয়ালে।
এই অবস্থায় প্ল্যাটফর্মের শেষ সীমা থেকে টানেলের ভিতরে প্রায় ৬০ ফুট চলে যান সজলবাবু। কামরার যাত্রীরা তত ক্ষণে আপৎকালীন অ্যালার্মের বোতাম টিপতে শুরু করেছেন। ধাক্কা দিচ্ছেন দরজা-জানলায়। অভিযোগ, তাতেও ট্রেন থামেনি। এর মাঝে কোনও ভাবে হাত আলগা হয়ে টানেলের এক পাশে ছিটকে পড়েন সজলবাবু।
মেট্রো সূত্রে দাবি করা হচ্ছে, আপৎকালীন অ্যালার্টের সঙ্কেত পেয়েই ইমার্জেন্সি ব্রেক কষে ট্রেন থামান চালক। তার পর সেটিকে ফিরিয়ে আনা হয় পার্ক স্ট্রিট স্টেশনে। টানেলেই পড়ে থাকেন সজলবাবু।
যাত্রীদের বক্তব্য, ট্রেনটি প্ল্যাটফর্মে ফিরিয়ে আনলেও কোনও দরজা খোলেনি। ততক্ষণে পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে ট্রেনের ভিতরে। পিছনের দিকের কামরার যাত্রীরা পোড়া গন্ধ পেয়ে আগুন লেগেছে বলে চিৎকার-চেঁচামেচিও শুরু করে দেন। ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন করে দেওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় এসি। ফলে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রায় কুড়ি মিনিট পরে গার্ডের দিকের দরজা দিয়ে যাত্রীদের একে একে প্ল্যাটফর্মে বের করে আনা হয়।
প্ল্যাটফর্মে নামার পরেই যাত্রীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। অভিযোগ, এই সময় এক মহিলা আরপিএফ কর্মী পাল্টা তাঁদের ‘জুতো’ দিয়ে মারার কথা বলেন। যাত্রী বিক্ষোভের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছন কলকাতা পুলিশের একাধিক থানার অফিসার, ডিসি সাউথ মিরাজ খালিদ-সহ বিশাল পুলিশ বাহিনী। পৌঁছন কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমও।
প্রায় ৪৫ মিনিট বন্ধ থাকার পরে সাড়ে সাতটা নাগাদ দক্ষিণমুখী মেট্রো চলাচল শুরু হয়। প্ল্যাটফর্ম খালি করার পরে নিয়ে আসা হয় সজলবাবুর দেহ। রাত পৌনে আটটা নাগাদ দেহটি এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
দেহ উদ্ধারে কেন এত দেরি হল, সেই প্রশ্ন উঠেছে। মেট্রো সূত্রের দাবি, ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ফিরিয়ে আনার পরে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন করে রেলকর্মীরা টানেলের ভিতরে যান। দুর্ঘটনা ঘটার ২৬ মিনিটের মাথায় সজলবাবুর দেহ টানেল থেকে তুলে প্ল্যাটফর্ম শেষ হওয়ার পরে যে উঁচু জায়গাটি আছে, সেখানে এনে রাখা হয়। ক্ষুব্ধ যাত্রীদের বুঝিয়েসুজিয়ে প্ল্যাটফর্ম খালি করার পরেই দেহ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ মেলে। মেট্রো কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, এই ধরনের ক্ষেত্রে ট্রেনে থাকা যাত্রীদের আগে নিরাপদে নামিয়ে আনাই নিয়ম।
এ দিনের ঘটনার কথা রেল বোর্ডকে জানানোর পাশাপাশি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গড়ার কথা ঘোষণা করেছেন মেট্রো কর্তৃপক্ষ। কমিটিতে থাকবেন চিফ অপারেশন ম্যানেজার, চিফ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (রোলিং স্টক) ও চিফ সিকিউরিটি কমিশনার। তাঁদের যত দ্রুত সম্ভব রিপোর্ট দিতে বলা হবে।